গত আট মাসে খুলনা মহানগরীতে ১৯ জন খুন হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় ১০৪ জনকে আসামী করা হয়েছে। তার মধ্যে পুলিশ ৭৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। রাঘববোয়ালরা রয়েছে ধরা ছোয়ার বাইরে। অথচ এ সব মামলায় এজাহার নামীয় আসামী মাত্র ৪১জন। কোন কোন মামলায় আসামী করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা। উল্লেখ করা হয়নি কোন সংখ্যা। তবে প্রকৃত সন্ত্রাসীরা ধরা পড়েনি। হত্যাকারী চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সব সময়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নগরীতে খুনের ঘটনা কমছে না বলে জানা গেছে।

কেএমপি সূত্রে প্রকাশ, গত জানুয়ারি মাসে খুন হয় পুরাতন রেলওয়ে কলোনীর বাসিন্দা মানিক হাওলাদার (৩৪)। এ ঘটনায় সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ১৩ জনকে আসামী করে এ মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ এ পর্যন্ত ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। একই মাসে বানরগাতী ইসলাম কমিশনার মোড়ের বাসিন্দা অপূর্ব কুমার সরকার (২৪) খুন হয়। এ ঘটনায় সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামা ২৫/৩০জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ১৪জনকে গ্রেফতার করে। ফেব্রুয়ারি মাসে দুই জন খুন হয়। এরমধ্যে খালিশপুর থানা এলাকায় খুন হয় নড়াইলের বাসিন্দা তাজকির আহমেদ (২৩)। এ ঘটনায় ৫ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। তবে পুলিশ এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা আল আমিন শেখ ওরফে ইমন (৩১) খুন হয়। এ ঘটনায় সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ১০ জনকে আসামী করা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মার্চ মাসে নিরালা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা শাহিনুল হক শাহিন (৫০) খুন হয়। এ ঘটনায় সদর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। এপ্রিল মাসে দু’টি খুনের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে বাগমারা এলাকায় পলাশ শেখ (১৬) নামের এক ব্যক্তি খুন হয়। এ ঘটনায় ১৬ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করে। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আড়ংঘাটা গাইকুড়ের বাসিন্দা নুর ইসলাম গাজী (৫৩) নামের এক ব্যক্তি খুন হয়। এ ঘটনায় আড়ংঘাটা থানায় অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মে মাসে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লবণচরা থানা এলাকায় অজ্ঞাত নামা এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। লবণচরা থানা এলাকায় নাঈম মোল্লা (২৪) নামের এক যুবক খুন হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। ময়ূর ব্রীজের পশ্চিম পাশে খুন হয় গোলাম হোসেন (২৫) নামের এক যুবক। এ ঘটনায় সোনাডাঙ্গা থানায় ১০ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি । সদর থানা এলাকায় নিলু বেগম (৬৫) নামের এক মহিলা খুন হয়। এ ঘটনায় সদর থানায় অজ্ঞাত নামাদের আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। হরিণটানা থানায় এলাকায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। মামলা হলেও গ্রেফতার নেই। জুন মাসে তিন জন খুন হয়। এরমধ্যে সোনাডাঙ্গা থানায় এলাকায় এক ব্যক্তি খুন হয়। এ ঘটনায় ১৪ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করলেও পুলিশ ৫জনকে গ্রেফতার। জিরোপয়েন্ট শিকদার মার্কেটের পিছনে জাহিদুর রহমান (৪৯) নামরে এক ব্যক্তি খুন হয়। এ ঘটনায় হরিণটানা থানায় তিনজনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে এ মামলায় ৫ জনকে গ্রেফতার করে। রাজবাধ দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা বাবুল দত্ত (৫০) নামের এক ব্যক্তি খুন হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে হরিণটানা থাানয় মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে। জুলাই মাসে নগরীতে ২টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নিরালা আবাসিক এলাকায় জাকির হোসেন (৫২) নামের এক ব্যক্তি খুন হয়। এ ঘটনায় সদর থানায় অজ্ঞাত নামাদের আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ এ ঘটানয় ২ জনকে গ্রেফতার করে। দৌলতপুর মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে খুন হয় সাবেক যুবদল নেতা মাহবুব মোল্লা (৪৮)। এ ঘটনায় নিহতের পিতা করিম মোল্লা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে দৌলতপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে। আগস্ট মাসে নগরীতে দু’জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে সবুজবাগ মসজিদ গলির বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন টগর (২৭) খুন হয়। এ ঘটনায় ৬ জনকে আসামী করে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করেছে। দৌলতপুর দিঘিরপূর্ব পাড়ের বাসিন্দা আল আমিন হাওলাদার (৪৩) খুন হয়। এ ঘটনায় দৌলতপুর থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এদিকে মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় নগরীর মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার খানাবাড়ির সামনে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলাকেটে হত্যা করে ঘের ব্যবসায়ী আল আমিনকে। দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, নিহত আল আমিনের ভাই আওলাদ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) খোন্দকার হোসেন আহমদ বলেন, গত আট মাসে খুলনা নগরীতে খুন হয় ১৯ জন। এরমধ্যে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৪জন, সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রাঘাতে ১০জন, ভাসমান লাশ উদ্ধার ২টি, ইজিবাইক চুরি করে চালককে খুন করা, স্বামীর নির্যাতনে ২ জন নিহত। এরমধ্যে একটি মামলায় চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। খুলনাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা টহল বাড়িয়েছি, বিশেষ চেকপোস্ট দিয়েছি শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়া যে খুনগুলো হচ্ছে এগুলোর বেশিরভাগই টার্গেট কিলিং। আমরা প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেফতার করেছি। আদালতের মাধ্যমে কোনো আসামি ছাড়া পেয়ে গেলে সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। খুলনার পুলিশ দাবি করছে, ৮ মাসে সংঘটিত হত্যাকান্ডের মধ্যে বেশির ভাগের কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জড়িতদের গ্রেফতারও করা হয়েছে।

খুলনা মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন খুলনা বিএনপির নেতারা। মহানগর বিএনপির সভাপতি এডভোকেট এস এম শফিকুল আলম মনা ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টুসহ পদস্থ নেতারা সম্প্রতি যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, খুন, অস্ত্রের মহড়া, চুরি, ডাকাতি ও লুটপাটের মতো ঘটনা খুলনায় নিত্যদিন ঘটছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গোলাগুলি, খুনসহ সন্ত্রাসী ঘটনা। তাঁরা বলেন, মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দায়ভার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। তাই দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

কেএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। যার ফলে অপরাধগুলো ঘটছে। দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার নিজ বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলযোগে আসা তিন অস্ত্রধারী মাহবুবুরকে (৪৮) প্রথমে গুলী করে হত্যা করে। এ ঘটনায় পুলিশ ৪ জনকে গ্রেফতার করে বলে ওসি মীর আতাউর আলী জানান। নিহত মাহবুবুরের স্ত্রী এ্যারিন সুলতানা জানান, ‘মূলত দুটি মামলাকে কেন্দ্র করেই তার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধ হয়। একটি মামলার বাদী মাহবুব নিজে এবং অন্যটির বাদী মো. জাকির হোসেন। ওই দুটি মামলার আসামীরা মাহবুবকে কয়েকবার হুমকি দিয়েছিল।’