হুসাইন বিন আফতাব, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা: প্রতিবছর এপ্রিল ও মে মাসে উপকূলীয় অঞ্চলের চার হাজারেরও বেশি পেশাদার মৌয়াল রওনা হন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের দিকে। তাঁদের লক্ষ্য সেই বন থেকে খাঁটি মধু সংগ্রহ করা। বছরজুড়ে যাঁদের জীবিকা দোল খায় মৌচাকে, তাঁদের কাছে এই দুই মাস যেন স্বপ্ন পূরণের মৌসুম।

সুন্দরবনের মধু শুধু এই অঞ্চলের মানুষের আয়ের উৎসই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও পরিচিত পণ্য। এর স্বাদ, ঘ্রাণ ও বিশুদ্ধতা অতুলনীয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পেশাদার মৌচাষিরা ফুলভিত্তিক নানা ধরনের মধু সংগ্রহ করলেও সুন্দরবনের মধু তার প্রাকৃতিক উৎপত্তি ও মানের কারণে স্বতন্ত্র। এই মধুর প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ যেমন ব্যাপক, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও এর সম্ভাবনা অগাধ।

এই সম্ভাবনাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পাওয়া ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। যদিও তার আগেই ২০২৪ সালে ভারত সুন্দরবনের মধুকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করায় বাংলাদেশের মৌয়াল, গবেষক ও মধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ তৈরি হয়। তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশও সুন্দরবনের মধুর জিআই সনদ লাভ করে, যা দেশের মধু শিল্পের জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।

তবে এই অর্জনের আনন্দের মাঝেও রয়েছে কিছু গভীর উদ্বেগ। মৌসুম শুরুর আগেই অর্থাৎ এপ্রিলের প্রথম দিনের আগে বিভিন্ন জেলে ও বাওয়ালিরা অসাধু মধু ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় পড়ে অপরিপক্ক মধুর চাক কেটে নিচ্ছেন। এতে শুধু মধুর গুণগত মানই নষ্ট হচ্ছে না, বরং প্রাকৃতিক প্রজননচক্রও ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে চিনি জ্বালিয়ে মধু তৈরি করছেন, বাক্সে মৌমাছি রেখে বনভিত্তিক মধু বলে চালাচ্ছেন। এসব কার্যকলাপে প্রকৃত মৌয়ালদের দুর্দশা বাড়ছে, আর বিশ্ববাজারে সুন্দরবনের মধুর খ্যাতিও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

২০২৪ সালে শুধু সাতক্ষীরা রেঞ্জেই ৩৬৪টি পাশের মাধ্যমে ১,২৩৫ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু ও ৩৭০ দশমিক ৬৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহ হয়েছে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৭ লাখ ৯২ হাজার ২৩০ টাকা। ২০২৫ সালে এ লক্ষ্য আরও বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১,৫০০ কুইন্টাল মধু ও ৪০০ কুইন্টাল মোম।

তবে এই সম্ভাবনার পথেও আছে চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বনাঞ্চলে ফুল ফোটার হার কমে গেছে। কারণ মধু উৎপাদনের সঙ্গে ফুলের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে আশার কথা, বন বিভাগ ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে গাছের সংখ্যা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে মধু উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হবে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রাকৃতিক মধু নিউজিল্যান্ডের ‘ভানুকা’ মধু, যা প্রতি কেজি ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সুন্দরবনের মধুও প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত, এবং উপযুক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ মধু আন্তর্জাতিক বাজারে একই মর্যাদা পেতে পারে।

সরকারিভাবে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন, মান নির্ধারণ ও রপ্তানির ব্যবস্থা করা গেলে এ খাত হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক বড় উৎস। এর ফলে যেমন দেশি-বিদেশি বাজারে চাহিদা বাড়বে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হবে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ, যা জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়তা করবে।

সুন্দরবনের মধু শুধুই এক বোতল সুস্বাদু তরল নয়; এটি আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, জীবিকাভিত্তিক সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আত্মনির্ভরতার এক প্রতীক। এ সম্পদকে রক্ষা ও কাজে লাগানো আমাদের দায়িত্ব, সম্মান এবং ভবিষ্যতের জন্য এক অপার সম্ভাবনার দ্বার।