তৌফিক রুবেল, দাউদকান্দি (কুমিল্লা) : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার রাজনৈতিক মানচিত্র উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, বিশেষ করে ২৪৯-তম আসন কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা)-এ। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ২০২৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য রোডম্যাপ ঘোষণার পর থেকেই এই নির্বাচনী এলাকার, গ্রামীণ আড্ডা থেকে শুরু করে হাট-বাজারের চায়ের দোকান পর্যন্ত, নির্বাচনী আলোচনা প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে এই আসনটি বিএনপির একটি শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এখানে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও এই আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তার দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এবারের মাঠে কেবল বিএনপিই একমাত্র সক্রিয় বিরোধী শক্তি নয়। বিশেষত, ৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা কার্যত নীরব ভূমিকায় রয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- দৃশ্যত স্থগিত থাকায় স্থানীয় সমর্থকেরাও নিশ্চুপ। একইসাথে, জাতীয় পার্টির অবস্থানও এই আসনে ভোটের অঙ্কে প্রায় নেই বললেই চলে। এই রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মাঠ পর্যায়ে বেশ সরব হয়ে উঠেছে। তবে পর্যবেক্ষক ও স্থানীয়দের মতামতে, জামায়াতে ইসলামীর প্রচারণা এবার সাধারণ মানুষের মধ্যে লক্ষ্যণীয়ভাবে সাড়া ফেলছে। দাউদকান্দি উপজেলা আমীর, সাবেক জেলা ছাত্রশিবির সভাপতি ও কুমিল্লা জেলা (উত্তর) মজলিসে শূরার সদস্য মনিরুজ্জামান বাহলুল জামায়াতের পক্ষে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত, জামায়াতের প্রসঙ্গটি আগের চেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করছেন যে, “অতীতে সব দলকেই ভোট দিয়ে দেখা হয়েছে, এবার জামায়াতকে পরখ করে দেখতে চাই।” এর বিপরীতে, বিএনপির কিছু নেতার কঠোর বক্তব্য বা ভীতিমূলক আচরণ কারো কারো মধ্যে কিছুটা বিরক্তি তৈরি করছে বলেও আলোচনা রয়েছে। এই দুইয়ের মিশ্রণে, বিএনপির দূর্গ হিসেবে পরিচিত এই আসনে জামায়াতের আকস্মিক উত্থানের আভাসকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন।
অতীতের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই আসনের ভোটাররা পরিবর্তনশীল। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার এখান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপির ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০১ সালেও তিনি চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। তবে ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার (২০০৮, ২০১৪-এর একতরফা ও ২০১৮-এর বিতর্কিত নির্বাচন) আওয়ামী লীগের মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার সবুর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।প্রায় সাড়ে চার লক্ষাধিক ভোটারের এই আসনটি দাউদকান্দি ও মেঘনা-এই দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ২ ৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা রয়েছে। ভোটের হিসাবে দাউদকান্দি উপজেলা এগিয়ে। দাউদকান্দির ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় মোট ভোটার ৩,২০,৫৩৩ জন (পুরুষ ১,৬৩,৪০০; মহিলা ১,৫৭,১৩৩)এবং মেঘনা ৮টি ইউনিয়নে মোট ভোটার ১,১২,৮৭১ জন (পুরুষ ৫৮,৫৩১; নারী ৫৪,৩৪০)।
ভোটের এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দেয় যে, মেঘনার তুলনায় দাউদকান্দির ভোটার সংখ্যা প্রায় তিনগুণ। স্থানীয় কবি হোসাইন মোহাম্মদ দিদারের মতে, এই অসাম্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই দাউদকান্দির প্রার্থীরাই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাবেন। তবে তার মতে, সংখ্যার চেয়েও জরুরি হলো একটি সুস্থ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, যাতে ২০১৮ সালের মতো অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি আরও কয়েকটি দল ও সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই) থেকে কেন্দ্রীয় যুগ্ন মহাসচিব প্রকৌশলী আশরাফুল আলমও মাঠপর্যায়ে দৃশ্যমান কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এছাড়া ভিপি নূরুর গণ অধিকার পরিষদ থেকে নাজমুল হাসান, খেলাফত আন্দোলন থেকে মুফতি সুলতান মহিউদ্দিন, ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ) থেকে মাওলানা আলতাফ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক) থেকে আবদুল হাই মক্কী, খেলাফত মজলিস (দেয়ালঘড়ি) থেকে সৈয়দ আবদুল কাদের জামান এবং এনসিপি থেকে ফারুক খন্দকারের নামও শোনা যাচ্ছে। জাতীয় পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলে কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটারও গুঞ্জন রয়েছে।
জামায়াতের প্রার্থী নির্বাচনী জোট প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান বাহলুল জানান, তারা দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কেন্দ্র যাকে মনোনয়ন দেবে, তাকেই স্বাগত জানানো হবে এবং নেতৃত্ব নিয়ে দলে বা জোটে কোনো বিভক্তি থাকবে না ইনশাআল্লাহ।
এদিকে, হেফাজতে ইসলাম এর দাউদকান্দি পৌরসভা সেক্রেটারি আবুল বাশার মনে করেন, জনগণ ইসলামী দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি নয়, বরং ঐক্য দেখতে চায়, যাতে দিনশেষে ইসলামের বিজয় হয়। অন্যদিকে, মেঘনার চন্দনপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মামুন আহমেদের মতে, সাধারণ ও অরাজনৈতিক মানুষের প্রত্যাশা ভিন্ন। তিনি বলেন, “আমি রাজনীতি করি না, তবে এমন একজন যোগ্য ও সৎ নেতৃত্ব চাই, যার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক পরিবেশ নিরাপদ থাকবে কুমিল্লা-১ আসনে।”