একেএম আবদুর রহীম, ফেনী সংবাদদাতা : ফেনী গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে অনেক সম্ভাবনার জাল বুনেছিল ফেনীবাসী তথা দেশবাসী। কিন্তু সকল স্বপ্ন আজ বিলীন হওয়ার পথে। ফেনীর ধলীয়া ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামে ১৯৮১ সালে পেট্রোবাংলা এই গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে যা ফেনী গ্যাসফিল্ড নামে পরিচিত। এই গ্যাসক্ষেত্রের কূপের গভীরতা ৩০০০ মিটার। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত। গ্যাসক্ষেত্রটি যখন আবিষ্কৃত হয় এবং এখানকার উত্তোলিত গ্যাস জাতীয় সঞ্চালন পাইপ লাইনে সরবরাহ হচ্ছিল তখন বলা হয়েছিল যে, এই গ্যাসক্ষেত্রে প্রচুর তেল এবং গ্যাস রয়েছে যা বহু বছর ধরে উত্তোলনযোগ্য।

সর্বশেষ এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক ২০ লাখ ঘনমিটার গ্যাস উত্তোলিত হয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা তখন বলেছিলেন যে, এখানে একাধিক কূপ খনন করে দৈনিক ৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। আশা জাগানিয়া সম্ভাবনার এই স্বপ্ন ফানুষ হঠাৎ করেই চুপসে যায়।

নাইকো এবং ভারতের কারসাজি : কানাডিয়ান তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান নাইকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল এই গ্যাসক্ষেত্র। ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৫ সালে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটিও নাইকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকার তখন নাইকোর বিরুদ্ধে দেশের আদালতে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউট) মামলা করেছিল। সরকার ১১ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করে। অপরদিকে সরকারের কাছে নাইকোর পাওনা ছিল সাড়ে তিন কোটি মার্কিন ডলার। তখন নাইকোও সরকারের বিরুদ্ধে পাওনার দাবিতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে। একই সাথে তারা ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করে দেয়।

এক কারণে সাময়িক বন্ধ হয়ে পরে ভিন্ন কারণে স্থায়ী বন্ধ যায়। গ্যাস ক্ষেত্রটি সাময়িক বন্ধ হয় নাইকোর সাথে মামলা জটিলতায়। সম্প্রতি যে মামলার রায়ে বাংলাদেশ নাইকো থেকে আট হাজার কোটি টাকা পেতে যাচ্ছে। অথচ অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা দখল করেই ঘোষণা করে অত্র গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য তেল গ্যাস কিছুই নেই। আর এটা বলে গ্যাসক্ষেত্রটি সিলগালা করে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়।

ষড়যন্ত্রের আভাস তখনই পাওয়া যায় : ২০১০ সালে যখন গ্যাস ক্ষেত্রটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয় তার পূর্বেই জানা গিয়েছিল যে এই গ্যাসক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেল রয়েছে। তবে এই গ্যাস ক্ষেত্রটির অপর একটি মুখ রয়েছে ফেনী সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরায়। তখন এমন কথাও বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছিল যে ভারতের পদলেহী আওয়ামী সরকার তাদের গদি রক্ষার স্বার্থে ভারতের চাপের কাছে নতি স্বিকার করে তাদেরই পরামর্শে এই গ্যাসক্ষেত্রটি সিলগালা করে দেয়। তখন বলা হয়েছিল যে এখানে মাত্র ৬৭ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অবশিষ্ট আছে।

এক নজরে বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ : বাংলাদেশ এশিয়ার ১৯ তম বৃহৎ গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। দেশীয় জ্বালানি চাহিদার ৫৬ শতাংশ পূরণ করে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে। সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় সিলেটের হরিপুরে ১৯৬৫ সালে এবং সর্বশেষ আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ভোলার ইলিশা। যা ২০২৩ সালে আবিষ্কৃত হয়। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সেলওয়েল কোম্পানি এটি আবিষ্কার করে। দেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলিত হয়ে জাতীয় গ্রীডে আসছে। অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, সিলেট, ছাতক, তিতাস, রশিদপুর, কৈলাস টিলা, হবিগঞ্জ, স্যামতাং, কুতুবদিয়া, বেগমগঞ্জ, কামতা, ফেনী, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জালালাবাদ, নরসিংদী, মেঘনা, শাহজাদপুর, শালদা নদী, সাঙ্গু, বিবিয়ানা ও মৌলভীবাজার।

বাংলাদেশে মোট গ্যাস : বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রসমূহের মোট মজুদ ২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তন্মধ্যে উত্তোলনযোগ্য অনুমিত মজুদ ২১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ২০১০ সাল নাগাদ ৮ ট্রিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। তখন পর্যন্ত অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ ১২.০১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

ফুরিয়ে আসছে গ্যাস সম্পদ : দ্রুত ফুরিয়ে আসছে দেশের এই অতি প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদ। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত মনোনিবেশ করতে হবে জলে এবং স্থলে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের দিকে। একই সাথে বন্ধ হওয়া গ্যাসক্ষেত্রগুলোও ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে যে আসলেই সেগুলো গ্যাস-শূন্য কিনা।