নির্বাচিত সরকার এবং পরিবেশ অনুকূলে আসলে আমার বাবার হত্যার বিচার চাইবো। অভিভাবক না থাকায় বিগত এক যুগ ধরে আমরা বাবার হত্যার বিচার চাইতে পারিনি। আমাদের কোন খুঁটি নেই। জামায়াত বিএনপির অসংখ্যা নেতা কর্মীকে আমার বাবার হত্যাকান্ডের ঘটনায় জেল জুলুম দিয়ে হয়রানী করেছে। তারা সম্পূর্ণ অন্যায় এবং জুলুমের শিকার। নিহত ভ্যান চালক মুনসুর আলী গাজীর বড় মেয়ে ডলি সেই দৃশ্য এখনও ভুলতে পারেননি। তিনি বলেন, আমি নিজ চোখে দেখেছি, পুলিশ গুলি করছে। আমার বাবাকে একজন এএসআই গুলি করে হত্যা করে। আজ তিনি জমি কিনে বাড়ি করেছেন, আর আমরা কষ্টে আছি। ঘটনার পর পুলিশ মামলার অনুমতি দেয়নি। তখন চারিদিকে ভয় আর চরম আতঙ্কের পরিবেশ। হরতাল-রাজনীতি আর দমননীতির মধ্যে পরিবারটি মুখ বন্ধ রেখেছিল। নিহতের স্ত্রী রেহেনা বেগম (৫০) বলেন, আমরা মামলা করতে পারিনি। ভয় ছিল, আবার পুলিশ আমাদের ক্ষতি করবে। তারপর থেকে সংসার চলছে কষ্টে। সংগঠন থেকে একটু সহায়তা পাই, কিন্তু বাচ্চাদের পড়াশোনা চালানো কঠিন।

তার বাড়ির সামনে ঝুলছে একটি সাইন বোর্ড। তাতে সাদা অক্ষরে লেখা শহীদ মুনসুর আলী গাজী। শহীদ হওয়ার তারিখ : ১১ এপ্রিল ২০১৩। সময় : সকাল ৭টা ৩০ মিনিট। স্থান : কেবি হাই স্কুলের পার্শ্বে। যেভাবে শহীদ হলেন : পুলিশের গুলিতে। বারো বছর পেরিয়ে গেলেও বোর্ডটি আজও মুছে যায়নি। শুধু পুরনো হয়ে গেছে অক্ষরগুলো, ধুলো জমেছে চারপাশে। কিন্তু মুনসুর আলীর স্ত্রী রেহেনা বেগম প্রতিদিন সকালে সেই বোর্ডের নিচে দাঁড়ান কিছুক্ষণ। কখনও হাত রাখেন, কখনও নিঃশব্দে বলেন, আমার স্বামী হত্যাকান্ডের বিচার চাই।

২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল দেশজুড়ে হরতালের ডাক। সকাল সাড়ে ৭টা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ডুমুরিয়ার চেঁচুড়ি হাইস্কুল সড়কে মিছিল বের করে। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল আসে মিছিল থামাতে। একপর্যায়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। গুলির শব্দে থমকে যায় চারপাশ। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়। কয়েকজন পড়ে যায় মাটিতে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মুনসুর আলী গাজী, কাটেংগা গ্রামের ইঞ্জিনভ্যান চালক, চার মেয়ের জনক।

মুনসুর আলী তখন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। বড় মেয়ে ডলি তখন স্কুলে পড়ে, ছোট মেয়েরা ঘরে। খবর পেয়ে ডলি দৌঁড়ে যায় স্কুলের পাশের রাস্তায়। সেখানেই পড়ে আছে তাঁর বাবার নিথর দেহ। ডলি আজও সেই দৃশ্য ভুলতে পারেননি।

স্থানীয়রা বলেন, মুনসুর আলী ছিলেন শান্ত স্বভাবের মানুষ, রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু হরতালের মিছিলে উপস্থিত থাকায় প্রাণ দিতে হয় তাঁকে।

গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক আনোয়ারুল আযম বলেন, আমরা দেখেছি, সে দিন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। মুনসুর আলী নিরস্ত্র ছিল। কিন্তু এই ঘটনায় কোনো তদন্ত হয়নি, কেউ দায় স্বীকারও করেনি। মুনসুর আলীর পরিবার আজও বিশ্বাস করে, একদিন ন্যায়বিচার আসবে। বড় মেয়ে ডলি বলেন, বিগত বারো বছর অত্যাচারী সরকার ছিল, কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। এখন যদি নিরাপদ পরিবেশ পাই, বাবার হত্যার বিচার চাইবো।

খুলনা মানবাধিকার কর্মী মনিরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবারগুলো প্রায়ই বিচারহীনতার শিকার হয়। দীর্ঘ সময় পার হলেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে এইসব ঘটনার পুনঃতদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার।