নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামের আলোচিত প্রতিষ্ঠান এলিট কর্পোরেশন ‘হারবাল ও আয়ুর্বেদিক’ পণ্যের আড়ালে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর নেপথ্যে মূলহোতা কামরুল কায়েস চৌধুরী, যিনি “জি এম আই টি” নামে একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই জিএমআইটির ব্যানারে ‘উদ্যোক্তা তৈরি’ কর্মসূচির নামে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের ফাঁদে ফেলে ‘বুলেটপ্রুফ মার্কেটিং’ কোর্স শেখানো হয়। তবে এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য প্রাণঘাতী হারবাল পণ্য বিক্রিতে তাদের ব্যবহার করা।
ভুয়া ছাড়পত্র ও প্রতারণার কৌশল : এলিট কর্পোরেশন তাদের পণ্য বাজারজাত করতে বিএসটিআই, বাংলাদেশ সাইন্সল্যাব, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)-এর নাম ব্যবহার করে নকল ছাড়পত্র তৈরি করে। এ ছাড়পত্রগুলো ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক নিখিল রায় জানান, “আমাদের অনুমোদিত ২৯৯টি পণ্যের তালিকায় এসব পণ্যের নাম নেই। যারা ভুয়া ছাড়পত্র ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সেলিব্রেটি দিয়ে বিজ্ঞাপন : তাদের তৃতীয় কৌশল হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় টিকটকার ও ইউটিউবারদের দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করা। এদের অধিকাংশই জানেন না যে, পণ্যগুলো লাইসেন্সবিহীন ও ক্ষতিকর। শুধু লোভনীয় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এসব প্রচারে অংশ নেন তারা।
চতুর্থ পর্যায়ে, এসব বিজ্ঞাপন ব্যক্তিগত আইডি থেকে প্রচার করা হয় টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকে। লক্ষ্য- দ্রুত ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া। পঞ্চম ধাপে, পণ্য সরবরাহে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস যেমন- পাঠাও, স্ট্রিট ফার্স্ট, সুন্দরবন কুরিয়ার ইত্যাদি। এতে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
প্রশাসনিক অভিযানে আংশিক সাফল্য : ২০২৩ সালের জুনে চট্টগ্রামের কুয়াইশ এলাকার একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে সেটি সিলগালা করা হয়। তবে একই বছরের আগস্টে বিপুল পরিমাণ ভেজাল হারবাল পণ্যসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আবারো অভিযান চালানো হয়, তবে কোনো গ্রেফতার না হলেও বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করা হয়।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও মিডিয়া ব্যবস্থাপনা : এক ভুক্তভোগীর ভাষ্যমতে, তৎকালীন সরকারদলীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ব্যবসা পরিচালনা করে। ষোলশহর ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদ আলমসহ ছাত্রলীগ নেতাদের উপদেষ্টা বানিয়ে প্রতারণা কার্যক্রমকে বৈধ রূপ দেওয়া হয়।
এই ভুক্তভোগী আরও অভিযোগ করেন, কামরুল কায়েস মোটা অংকের অর্থ দিয়ে পত্রিকার সম্পাদকদের চাপে ফেলে প্রতিবাদ প্রকাশ করিয়ে নিতেন। এমনকি কিছু পত্রিকায় উপদেষ্টা পদও কিনে নেন। এসব কৌশল তার প্রতারণার অংশ বলে দাবি তার।
ভোক্তাদের জীবন ঝুঁকিতে : ভুক্তভোগীরা জানান, পণ্যের মোড়ক ও নাম পরিবর্তন করলেও ভেতরের উপাদান অপরিবর্তিত। এসব ভুয়া হারবাল পণ্য সেবনে স্বাস্থ্যঝুঁকি ব্যাপক। ২০১৪ সালের বিজ্ঞাপন নীতিমালার চরম লঙ্ঘন ঘটিয়ে এই কোম্পানি প্রতিনিয়ত আইন ভাঙছে।
প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এসব বিষবাণিজ্য বন্ধ হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জোর দাবি তুলেছেন প্রাণঘাতী হারবাল পণ্য যেন দ্রুত বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়।
এ বিষয় জানতে চাইলে কামরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, আমি কোনো প্রাণঘাতী হারবাল পণ্যের ব্যবসা করি না। কিছু চাঁদাবাজ এসব কথা বলে আমার কাছে টাকা দাবি করেন।