সাতক্ষীরার সাবেক পুলিশ সুপার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক উপকমিশনার কাজী মনিরুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করায় সাতক্ষীরায় উল্লাসে ফেটে পড়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। বরখাস্তের খবর পাওয়ার পর তারা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি বিতরণ করেন। দায়িত্বকালে তার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, স্বর্ণ লুট, ভিন্নমত দমনসহ একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া, প্রায় রাতেই মদ্যপান করে বাসায় ফিরাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার হিসেবে ২০২২ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিএনপি ও জামায়াত কর্মীদের জন্য ‘আতঙ্ক’ হয়ে ওঠেন মনিরুজ্জামান।
তালা উপজেলার এক সাংবাদিক বলেন, সাবেক ডিবি ওসির মাধ্যমে তাকে আটক করে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়, পরে ৭ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান। ২০২৩ সালে তার বিরুদ্ধে ২০টি স্বর্ণের বার লুটের অভিযোগও পুলিশ সদর দপ্তরে জমা হয়, তবে তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত বছরের ডিসেম্বর তাকে ডিএমপির উপকমিশনার পদে বদলি করা হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রংপুর রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২৫ নভেম্বর থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাকে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী ‘অসদাচরণ ও পলায়নে’র অপরাধে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তকালীন তিনি খোরপোশ ভাতা পাবেন।
পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের পুরো সময় অবৈধ অর্থের নেশায় বেপরোয়া ছিলেন কাজী মনিরুজ্জামান। সাতক্ষীরা জেলায় থাকাকালীন পুলিশ সুপার কার্যালয় ও থানাগুলোকে তিনি অনাচারের দুর্গে পরিণত করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মনিরুজ্জামানের সাবেক কর্মস্থল সাতক্ষীরা জেলায় তার ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বেছে বেছে অর্থশালীদের আটক করতেন মনিরুজ্জামান। এরপর মিথ্যা মামলা আর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আদায় করতেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আসা যেসব স্বর্ণের চালান সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে পাচার হতো সেগুলো লুট করতে কাজী মনিরুজ্জামান সাদা পোশাকধারী বিশেষ টিম গড়ে তোলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার হয়ে আসেন কাজী মনিরুজ্জামান। এর আগেও ২০১৩ সালে সাতক্ষীরা সদর সার্কেল এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। হয়েছেন খুলনা রেঞ্জের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপারও। তবে পুলিশ সুপার হয়ে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী মত দমনের নামে শুরু করেন অত্যাচার—নির্যাতন এবং অর্থ লুট।
নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা পৌর বিএনপির সভাপতি মাসুম বিল্লাহ শাহীন বলেন, ২০২৩ সালের ২৭ মে রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকা থেকে সাদা পোশাকে একটি মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নেন কয়েকজন। এরপর কয়েক দফা নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে ওই দলের একজন সদস্য বলেন, যেখানে আওয়ামী লীগের কোনো এমপি কথা বলার সাহস পায় না, সেখানে তুই মনিরুজ্জামান স্যারের সঙ্গে লাগতে যাস। স্যার বলছে তোর কলিজাটা ছিঁড়ে ওজন করতে।
মাসুম বিল্লাহ শাহীন জানান, হাইকোর্টে জামিন নিতে গেলে হাইকোর্ট এলাকা থেকে সাদা পোশাকে একটি মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নেওয়া হয়। পরে অস্ত্রসহ আটক দেখায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে। চোখ বেঁধে তাকে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা আনা হয়। পথিমধ্যে বেশ কয়েকবার গাড়ি থেকে নামিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়। ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে এসপি মনিরুজ্জামান তার ওপর অত্যাচার এবং বাড়ি ভাঙচুর করেন বলে অভিযোগ করেন মাসুম বিল্লাহ।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মনিরুজ্জামানের নির্দেশে দিনভর অভিযান চালিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের আটক করতেন তারা। এরপর রাত ১২টার পর তাদের হাজির করা হতো মনিরুজ্জামানের সামনে। সেখানে আটককৃতদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ টাকা আদায় করা হতো। যারা দিতে পারতেন না তাদের বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো।
বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন দেড় বছরে তিনি শতকোটি টাকার বেশি লুট করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মনিরুজ্জামানের নির্দেশে দিনভর অভিযান চালিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের আটক করতেন তারা। এরপর রাত ১২টার পর তাদের হাজির করা হতো মনিরুজ্জামানের সামনে। সেখানে আটককৃতদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ টাকা আদায় করা হতো। যারা দিতে পারতেন না তাদের বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো।
ইত্যোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ডর্জন খানিক হত্যা মামলা দায়ের করেছে ভুক্ত ভোগী পরিবার।
মনিরুজ্জামানের ঘুষকান্ডের ভুক্তভোগী জেলার আলিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আব্দুর রউফের সঙ্গে কথা হয় । তার দাবি, বিভিন্ন সময়ে তাকে আটক করে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন কাজী মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামানের নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি সাংবাদিকও। হাসান নামে জেলার স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, তাকে তুলে নিয়ে গুমের ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা আদায় করেন মনিরুজ্জামান। তার পরিবার এই এসপির কারণে এখন প্রায় নিঃস্ব।
বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন দেড় বছরে তিনি শতকোটি টাকার বেশি লুট করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, মোটা টাকা ব্যয় করে তিনি পোস্টিং নিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে। ছিলেন পুলিশের আলোচিত ডিআইজি হারুন উর রশিদের স্নেহভাজন।
রবিবার (১০ জুলাই ২০২৫) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ—১ শাখা থেকে এই বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির স্বাক্ষর রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রংপুর রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ে সংযুক্ত ডিএমপির সাবেক উপ—কমিশনার কাজী মনিরুজ্জামান কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই গত বছরের ২৫ নভেম্বর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। এটি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮—এর ৩(খ) ও ৩(গ) ধারা অনুযায়ী ‘অসদাচরণ ও পলায়নে’র শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর আগে চট্টগ্রামের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজিসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকেও একই বিধিমালার আওতায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।
প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি খোরপোশ ভাতা পাবেন। কাজী মনিরুজ্জামানকে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তার দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে, যার মধ্যে রয়েছে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, সোনা লুট এবং ভিন্নমত দমন।
তিনি সাতক্ষীরাতে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য এক আতঙ্কের নাম ছিল। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সাংবাদিক কল্যান ব্যানার্জিকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। দৈনিক সংগ্রামে জেলা সংবাদদাতা আবু সাইদ বিশ্বাসকে গ্রেফতার করতে সরকারের সবকটি বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। পরে কয়েকটি গাযেবেী মামলায় তাকে আসামী করা হয়। অসংখ্য সাংবাদিক তার ভয়ে মাসের পর মাস পালিয়ে থাকত বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাজী মনিরুজ্জামান ১৯৭৬ সালের ৩০ জুন ঝিনাইদহের গোবিনাথপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালে হরিনাকুন্ডু পিএনহাই স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে এমএসএস ডিগ্রি লাভ করেন।