ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নতুন করে আরও চারটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ -গ্রামের চার প্রান্তিক কৃষককে ব্যবসায়ী হিসেবে দেখিয়ে জাল কাগজপত্র তৈরি করে নিজেদের মালিকানাধীন ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল) থেকে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ঋণ তুলে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুদকের সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ এ মামলাগুলো নেওয়া হয় বলে জানান উপ-পরিচালক সুবেল আহমেদ।
দুদকের মামলার নথিতে বলা হয়েছে, আসামীরা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র হিসেবে কাজ করেছে। তারা সহজ-সরল কৃষক মো. ইউনুস, নুরুল বশর, ফরিদুল আলম ও মো. আইয়ূবের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের অজান্তে ভুয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বানান। এরপর সেই প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে বিপুল পরিমাণ ঋণ অনুমোদন করে টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেন।
কৃষক ইউনুসের নামে ৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা তোলার মামলা : এই ঘটনায় প্রথম মামলায় সাবেক মন্ত্রী জাবেদের ভাই ও ইউসিবিএল’র সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী, আরেক ভাই সাবেক পরিচালক আসিফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক পরিচালক বশির আহমেদসহ মোট ১৩ জনকে আসামী করা হয়েছে। অভিযোগ- বিএন্ডবি ইলেকট্রনিকসের কর্মচারী মোস্তাফিজুর রহমানকে ব্যবহার করে ইউনুসকে ‘ইউনাইটেড ট্রেডিং’-এর মালিক সাজিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা তুলেছেন তারা।
কৃষক আইয়ূবকে ‘আমদানিকারক’ সাজিয়ে আত্মসাৎ : দ্বিতীয় মামলায় মো. আইয়ূব নামে এক কৃষকের নামে ‘মোহাম্মদীয়া এন্টারপ্রাইজ’ খোলেন আসামীরা। ইলেকট্রনিক্স ও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক পরিচয় দিয়ে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ তোলা হয়। এ মামলায় জাবেদের স্ত্রী রুকমিলা জামান ও বোন রোকসানা জামান চৌধুরীসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
নুরুল বশরের নামে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা তুলে পাচার : তৃতীয় মামলায় নুরুল বশরকে ‘বশর ইন্টারন্যাশনাল’-এর মালিক দেখিয়ে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে সাবেক মন্ত্রী, তার স্ত্রী, দুই ভাই, ব্যাংকের সাবেক পরিচালক, আরামিট সিমেন্টের কর্মকর্তা ও অন্যদেরসহ মোট ১৯ জনের নাম রয়েছে।
ফরিদুল আলমকে দিয়ে আরও ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোপাট : চতুর্থ মামলায় ফরিদুল আলম নামে কৃষকের পরিচয়ে ‘ইউনিক এন্টারপ্রাইজ’ নামের ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে আরও ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ আত্মসাৎ করেন আসামীরা। এ মামলায়ও জাবেদ, তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যসহ ১৯ জনকে আসামী করা হয়েছে।
চারটি মামলাতেই দণ্ডবিধির প্রতারণা, জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গ, দলিল জাল, প্রতারণার সহায়তা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
জাবেদের রাজনৈতিক অতীত : প্রয়াত শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বড় ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ প্রথমদিকে সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপ ও ইউসিবিএল ব্যাংক পরিচালনা করতেন। ২০১২ সালে বাবুর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে আসেন এবং পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও পরে পূর্ণমন্ত্রী হন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হন তিনি। টিআইবির প্রতিবেদনে তার ‘ইমেজ-সাজানো রাজনীতি’ প্রকাশ পেলে মন্ত্রিসভায় জায়গা হারান। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই তিনি দেশ ত্যাগ করেন। পরে লন্ডনে তার অবস্থানের খবর প্রকাশিত হয়।
আগেও ১৪০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং মামলা : এর আগে জাবেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৪০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে মানিলন্ডারিং আইনে আরও ছয়টি মামলা দায়ের করেছিল দুদক।