আবু সাইদ বিশ্বাস, সীমান্ত অঞ্চল সাতক্ষীরা থেকে: বাংলাদেশের ২৯টি সীমান্তবর্তী জেলার ১৬২টি রুট দিয়ে দেশে দেদারছে প্রবেশ করছে মাদক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিত্যনতুন কৌশলে ইয়াবা, আইস, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, টপেন্টাডল, কোকেনের মতো ভয়াবহ মাদক সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও বাস্তবে তাদের প্রভাবশালী মহলই মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিল। ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ও মাদকের সেই প্রভাবশালী মহলের হাত বদল ঘটে। একই সঙ্গে দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নতুন মাদকসেবীর সংখ্যা। দেশে এখন মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮৩ লাখ। মাদকাসক্তদের বেশির ভাগ পুরুষ। নারী ও শিশুদের মধ্যেও মাদকাসক্তি রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক সমীক্ষায় মাদকাসক্ত জনসংখ্যার এই প্রাক্কলন করা হয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৬১ লাখ গাঁজায় (প্রায় ৫২ শতাংশ), ২৩ লাখ ইয়াবায় (প্রায় ২০ শতাংশ) ও ২০ লাখ ২৪ হাজার মদ্যপানে (১৭ শতাংশ) আসক্ত। ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে এবং ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ হেরোইনে আসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সমীক্ষায় দেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলা থেকে ৫ হাজারের বেশি মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে মাদকাসক্তির হিসাব তৈরি করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফলের অংশে বলা হয়, দেশে প্রাক্কলিত মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৩ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জনসংখ্যা ধরা হয়েছে সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারি অনুযায়ী ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার। এসব মাদকাসক্তের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলাতে বেশি। গোটা জেলা যেন মাদকে ভাসছে।

ডিএনসির তথ্য বলছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সব সংস্থা মিলে ২০ কোটি ১১ লাখ ৫৮ হাজার ২২১ পিস ইয়াবা, ২ হাজার ১৯৩ কেজি হেরোইন, ১৫৩ কেজি কোকেন, ২২৩ কেজি আফিম, ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ কেজি গাঁজা, ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩৭ বোতল ও ৬৪৬ লিটার ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। আর চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৯ পিস ইয়াবা, ৬৩ কেজি হেরোইন, ১০ কেজি কোকেন, ৮০০ গ্রাম আফিম, ৩৫ হাজার ১২১ কেজি গাঁজা, ১ লাখ ৭৫ হাজার ২২৭ পিস ও ৭৬ লিটার ফেনসিডিল, ৬৮ হাজার ৪৬৫ বোতল ও ৫ হাজার ১১৯ লিটার বিদেশি মদ, ৮ হাজার ৫২১ ক্যান ও ৫ হাজার ৩৫৪ বোতল বিয়ার জব্দ করা হয়েছে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ জুন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস।

মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের পথ (রুট) গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) এবং গোল্ডেন ওয়েজের (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ) একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান হওয়ায় এমন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দেশের ৩২টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। এসব জেলার অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাদক দেশে আসছে। মাদকবিষয়ক প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ৮ জেলার ৪৩টি, পূর্বাঞ্চলের ৪ জেলার ২১টি, উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার ২১টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৬৯৮টি মাদক মামলার রায় হয়েছে, তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের বিস্তারের ফলে তরুণদের একাংশের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তি বাড়ে। মাদকাসক্তরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা নানা রোগে আক্রান্ত হন। মাদকাসক্তি ও রোগের চিকিৎসায় বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। মাদক চোরাচালানে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়।

অবশ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৮৭টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। নতুন করে সরকারিভাবে ঢাকায় ২৫০ শয্যার এবং দেশের বাকি ৭টি বিভাগে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট আরও ৭ পূর্ণাঙ্গ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক নির্মূলে রাষ্ট্র সমন্বিত উদ্যোগ না নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে এবং মাদক প্রতিরোধের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর কেউ কেউ নিজেরাই কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। আর এ কারণেই জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরেও মাদকের লাগাম টানা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে মাদকের বিস্তারের কারণে অন্যান্য অপরাধ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। সমন্বিত উদ্যোগ ও সত্যিকারের জিরো টলারেন্স বলতে যা বোঝায় রাষ্ট্র সেই পদেক্ষেপ না নিলে কখনোই মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

বিজিবির সাতক্ষীরা ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশরাফুল হক জানান সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত মাদক দ্রব্য আসছে। যার বড় একটি অংশ তারা জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।

“জীবন একটাই, তাকে ভালবাসুন মাদক থেকে দূরে থাকুন” এই প্রতিপাদ্যে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বেলা ১০টায় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, সাতক্ষীরাকে মাদক মুক্ত করতে প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি ও এনজিও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ডোপ টেস্টে করা এবং মাদকের সাথে যুক্ত সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।