বাইরে থেকে খুলনা মহানগরীতে প্রবেশের পাঁচটির মধ্যে চারটি সংযোগ সড়কই দীর্ঘদিন ধরে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে একটি সড়কের মালিক খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-কেডিএ, দু’টির আংশিক মালিক খুলনা সিটি কর্পোরেশন-কেসিসি ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি এবং অপরটির মালিক সড়ক ও জনপথ (সওজ)। সড়কগুলো হচ্ছে, নগরীর পূর্ব-দক্ষিণের রূপসা সেতু থেকে রূপসা ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত সড়ক, দক্ষিণ-পূর্ব দিকের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ময়ূর নদের গল্লামরী ব্রিজ ও দু’পাশের সড়ক, পশ্চিমের খালাসী মোড় থেকে সোনাডাঙ্গা থানা পর্যন্ত সড়ক এবং খুলনা সিটি বাইপাস থেকে বিশেষায়িত হাসপাতাল পর্যন্ত বাস্তুহারা বাইপাস সড়ক।

সিটি বাইপাসের মোস্তফার মোড় থেকে বয়রা পর্যন্ত জলিল সরণীর একাংশ সম্প্রতি সংস্কার হলেও মাঝপথে এমনভাবে আঁকাবাঁকা রয়েছে যেখান থেকে বড় যানবাহনগুলোকে চলতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে। তার পরেও পাঁচটির মধ্যে ওই একটি সড়কই এখন মোটামুটি সচল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চারটি সড়কের মধ্যে গল্লামারী সেতুর দু’পাশের দোকানপাট উচ্ছেদ করে সড়কের কাজ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে সওজ। সোনাডাঙ্গা থানার সামনে থেকে ময়ুরি ব্রীজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে রমজানের ব্রীজ পর্যন্ত সড়কের সংস্কার করবে কেসিসি। ওই সড়ক দু’টির ব্রীজের অপর পাশের অংশের কাজ করবে এলজিইডি। তবে কেসিসি সোনাডাঙ্গার কাজটির জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং বিশেষায়িত হাসপাতালের সামনের অংশের সংস্কার কার্যক্রম শুরু করলেও ব্রীজের অপর পাশের সংস্কারের কোন উদ্যোগ এখনও নেয়নি এলজিইডি। এজন্য শহরের অংশের সংস্কার হলেও সড়ক দু’টি যে সহসাই চলাচলের উপযোগী হচ্ছেনা সেটি অনেকটা স্পষ্ট। আবার গল্লামারী সেতুর দু’পাশের রাস্তা সংস্কার হলেও যতক্ষণ সেতুটি নির্মাণ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানের অবস্থারও উন্নতি হচ্ছে না। এজন্য সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থায়ও আনা হয়েছে পরিবর্তন। যেটি যানবাহন চলাচলের জন্য আরও দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। খুলনা শিপইয়ার্ড সড়কের কাজ প্রায় এক যুগেও শেষ হয়নি।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন গল্লামারী স্টিল আর্চ সেতুটি সাড়ে ৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে। ৬৮ দশমিক ৭০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৩ দশমিক ৭০ মিটার প্রস্থের সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের (২০২৪) ৩০ জুন। প্রথম দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় চলতি বছরের (২০২৫) ৩০ মার্চ পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যেও শেষ করতে না পারায় দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু সেই মেয়াদও অতিবাহিত হয়েছে। এ জন্য তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক ও সওজ’র খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, বর্ধিত মেয়াদ তথা আগামী বছর জুনের মধ্যে গল্লামারী সেতুর কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উল্লিখিত চারটির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাস্তুহারা বাইপাস সড়কটির। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায় তেমন কোন যানবাহনই ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করছে না। দু’একটি ট্রাক চলাচল করছে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে। এছাড়া দৈনন্দিন কাজের জন্য যাতায়াত করছেন কিছু দিনমজুর। অনেক সময় খানা-খন্দের পাশ দিয়ে ট্রাক চলাচল করায় পাশের বাইসাইকেল আরোহী বা পথচারীদের মধ্যে আতংক দেখা দেয়।

ওই এলাকার বাসিন্দা খুলনা প্রেসক্লাবের আহবায়ক এনামুল হক বলেন, সড়কটি নির্মাণ করে কেডিএ। পরে তারা হস্তান্তর করে দু’টি সংস্থা তথা কেসিসি ও এলজিইডিকে। সম্প্রতি কেসিসির অংশে কাজ শুরু হলেও এলজিইডির কাজের কোন গতি নেই। এর ফলে ওই সড়কের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের পাশাপাশি শহরে প্রবেশের জন্য বাইরে থেকে আসা মানুষদেরকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, খুলনার দু’টি সংস্থার মধ্যে রসি টানাটানিতে নাগরিক জীবনে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। এর একটি কেডিএ অপরটি কেসিসি। এখন আবার এই সমন্বয়হীনতার সাথে যুক্ত হয়েছে সওজ ও এলজিইডি। এসব সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে খুলনাবাসীর যে দুর্ভোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এর প্রতিকার হওয়া দরকার।

কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. মশিউজ্জামান বলেন, সোনাডাঙ্গা থানার সামনে থেকে ময়ূরী ব্রিজ পর্যন্ত ৭৮০ মিটার সড়কের দু’পাশের ৩০ ফুট চওড়া করে ড্রেনের কাজের জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পের কাজে একটু দেরি হচ্ছে সেহেতু আপাতত: ড্রেনের কাজ করা হবে। এছাড়া বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে রমজানের ব্রীজ পর্যন্ত বাস্তুহারা সড়কটির কেসিসি অংশের সংস্কার কাজও শুরু হয়েছে।

কেডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী (পূর্ত) ও শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আরমান হোসেন বলেন, ওই সড়কটির ৭২ শতাংশ কাজ এ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। কেডিএ’র সূত্র মতে, খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প ২০১৩ সালে একনেকে অনুমোদন পায়। প্রায় ৯ বছর পর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় চার কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের এ কাজটি। ৯৯ কোটি থেকে এর ব্যয় এখন দাঁড়িয়েছে ২৫৪ কোটি টাকায়। মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফায়। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় জনদুর্ভোগ বাড়ছেই।

শিপইয়ার্ড সড়কের কাজ দ্রুত শেষ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি নিসচার : খুলনার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে খানজাহান আলী (রূপসা) সেতু পর্যন্ত প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ১২ বছরেও সংস্কার না হওয়ায় বড় বড় গর্ত, উঁচু-নিচু ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। সড়কটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স সংস্কার কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে কাজটি ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ ঘটানো, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করায় গত ৭ আগস্ট মাহাবুব ব্রাদার্সের সঙ্গে কাজের চুক্তি বাতিল করেছে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। এতে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক সংস্কার, লবণচরা সেতু ও মতিয়াখালী স্লুইচগেটের নির্মাণ কাজ। যা খুলনাবাসীল জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সড়কের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে রাখা হচ্ছে। অবিলম্বে সংস্কার কাজ শুরু না হলে বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর খুলনার মহানগর শাখার নেতারা।

রোববার (১৭ আগস্ট) নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি শেখ মো. নাসির উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মুন্না এক বিবৃতিতে জানান, দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বড় বড় গর্তের কারণে যানবাহন চলাচল প্রায় অচল হয়ে পড়েছে শিপইয়ার্ড সড়কে। এক সময়ের ব্যস্ততম এই সড়কে এখন ইজিবাইক চালকরাও চলতে চান না। বৃষ্টি ও জোয়ার এলে পুরো সড়ক পানিতে ডুবে থাকে। তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। যাতায়াতকারীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়। এই সড়ক দিয়ে শহরে প্রবেশ করে বান্দাবাজার, চানমারী, শিপইয়ার্ড এলাকা, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, আধুনিক রাইস মিল ও চিংড়ি প্রসেসিং জোনের কয়েক হাজার শ্রমিক। রয়েছে বাসস্থান ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত। অথচ প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ সড়কের গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে প্রকল্পের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে করা হয়েছে লুটপাট। এই সড়ক দ্রুত সংস্কারের কাজ শুরু না হলে খুলনাবাসীকে সাথে নিয়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হবে।