গাজীপুর থেকে মোঃ রেজাউল বারী বাবুল: গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ত চান্দনা চৌরাস্তা- এলাকাটি সাধারণত গার্মেন্টস শ্রমিক, দোকানপাট আর পথচারীর কোলাহলে সরগরম। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে এখানে রক্তের দাগ, আতঙ্ক আর সাংবাদিক হত্যার গল্প মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নিহত ব্যক্তি মো. আসাদুজ্জামান তুহিন, দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর সাহসী স্টাফ রিপোর্টার। হত্যার পেছনে ছিল একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের ভয়ংকর ফাঁদ হানিট্র্যাপ।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনার মূল নায়ক মিজান ওরফে কেটু মিজান। সে তার স্ত্রী গোলাপীকে ব্যবহার করে গার্মেন্টস শ্রমিক বাদশাকে হানিট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল।
বাদশা বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তুলে ফিরছিলেন। পথে গোলাপী তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। প্রতারণা টের পেয়ে বাদশা সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে গোলাপী তার পথ আটকায়, হাতাহাতি হয়। বাদশা প্রতিরোধ করলে মিজানের নেতৃত্বে লুকিয়ে থাকা চক্রের সদস্যরা বাদশার ওপর চাপাতি দিয়ে হামলা চালায়।
সেই দৃশ্য ধারণ করছিলেন সাংবাদিক তুহিন। ক্যামেরা (মোবাইল) তাক করতেই সন্ত্রাসীরা বুঝে ফেলে—ভিডিও ধ্বংস করতে হবে। তারা তুহিনকে মুছে ফেলতে চাপ দেয়, কিন্তু ব্যর্থ হলে পাশের দোকানে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।
তদন্তে আসছে নতুন মোড়?
পুলিশের একটি গোপন সূত্র জানায়—গ্রেপ্তারকৃতদের ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এখনো উদ্ধার হয়নি তুহিনের সেই মোবাইল ফোন, যা ছিল হত্যাকারীদের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক।
সূত্রের দাবি—টার্গেট ছিল বাদশা, কিন্তু ভিডিও করার অপরাধে তুহিনকে হত্যা করার ঘটনা হয়তো আসল মোটিভ নয়। “এখানে অন্য কারও নির্দেশ বা গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে”, বলছে তদন্ত দল।
পুলিশ এখন খুঁজছেÑ কারা এই খুনিদের মদদ দিয়েছে, এবং কেন একজন সাংবাদিককে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। পুলিশের একটি সূত্র জানান, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গ্রেপ্তার ও পলাতক আসামী
সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত ৮ জনের মধ্যে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন জামালপুরের মেলান্দহ থানার মাহমুদপুর গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে মো. মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৪), যিনি বর্তমানে মহানগরের বাসন মেট্রো থানার চান্দনা এলাকায় বসবাস করতেন, এবং তার স্ত্রী জামালপুরের মেলান্দহ থানার ফেরিঘাট গ্রামের মোঃ সোলাইমানের মেয়ে পারুল আক্তার ওরফে গোলাপি (২৮), এদের দুজনকে গাজীপুর জেলাধীন জয়দেবপুর থানার ভবানীপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাবনার ফরিদপুর থানার সোনাহারা গ্রামের মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন (২৮) যাকে র্যাব সদর মেট্রো থানাধীন শিববাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গা থানার ময়লাপোতা গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ মিয়ার ছেলে মো. আল আমিন (২১), যিনি বর্তমানে গাজীপুর সদর মেট্রো থানা দিন সাধুপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন, তাকে ডিএমপি তুরাগ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুমিল্লার হোমনা থানার অনন্তপুর গ্রামের মোঃ হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে মো. শাহজালাল (৩২) যাকে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানাধীন চর মসশলন্দ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাবনার চাটমোহর থানার পাচবাড়ীয়া গ্রামের কিয়ামউদ্দিন হাসানের ছেলে মো. ফয়সাল হাসান (২৩), যিনি গাজীপুর মেট্রো বাসন থানাধীন চান্না এলাকার রফিকুল ইসলামের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন, তাকে চান্না এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শেরপুর জেলার নকলা থানার চিতলিয়া গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সুমন ওরফে সাব্বির (২৬) তাকে বাসন থানাধীন চান্দনা, চান্দনা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জিএমপি কমিশনার আরো জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মিজান ওরফে কেটু মিজানের বিরুদ্ধে পূর্বের ১৫টি মামলা, শাহজালালের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা, আল আমীন ও স্বাধীন এবং সুমনের বিরুদ্ধে ২টি করে মামলা রয়েছে।
এছাড়া পলাতক নীল জামা পরা আরমানকে ধরতে পুলিশ অভিযানে রয়েছে।
সাংবাদিকদের হুমকি : এদিকে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করার সময় পুলিশের সামনেই গ্রেফতারকৃত প্রধান আসামী কেটু মিজান জেল থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার কড়া হুমকি দিয়েছে। এতে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে।
র্যাবের জালে আরো এক হত্যাকারী : অপরদিকে জিএমপি’র উপ-কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) রবিউল হাসান জানান, গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত অপর একজনকে শনিবার কিশোরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতারকৃতের নাম শহিদুল ইসলাম। তার বিস্তারিত পরিচয় জানা যায় নি। গ্রেফতারকৃত শহিদুলকে আনার জন্য বিকেলে পুলিশের একটি টিম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। এ নিয়ে সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত ৮জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র্যাবের একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত স্বাধীনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শহিদুলকে গ্রেফতার করা হয়।
অস্ত্র ও অপরাধের ইতিহাসঃ গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে উদ্ধার—একটি রামদা, একটি ব্যাটন-স্টিক, তিনটি চাপাতি।
তাদের সবার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলার রেকর্ড রয়েছে। এ চক্র গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে আসছে।
পুলিশের প্রতিশ্রুতি ও সাংবাদিক সমাজের ক্ষোভঃ জিএমপি কমিশনার ডক্টর নাজমুল করিম খান শনিবার তার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন— “সাংবাদিক তুহিন হত্যাকান্ডটি ছিল সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পেলেই ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।” সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো পুলিশ এখনো ট্রমার মধ্যে আছে, একজন পুলিশের কাজ তিনজন পুলিশ মিলেও করতে পারছে না। আমরা চেষ্টা করছি সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করেন এবং আমাদের কাজ করতে দিন। পুলিশ তার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং এর রেজাল্ট আপনারা শীঘ্রই দেখতে পাবেন।
এদিকে শনিবার গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
সাংবাদিক সংগঠনগুলো বলছে—এটি শুধু একজন সাংবাদিকের মৃত্যু নয়, সত্যের কণ্ঠরোধের একটি নির্মম উদাহরণ। অপরাধীদের দ্রুত বিচার না হলে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড আরও বেড়ে যাবে।
গাজীপুরের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে—হানিট্র্যাপ থেকে শুরু হওয়া এই রক্তাক্ত খেলায় কারা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বে, আর কে বা কারা এই হত্যার আসল মাস্টারমাইন্ড তা দেখার জন্যে।