পৃথিবীটা কি পরিবর্তনের মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে? প্রথম বিশ্ব বলুন, কিংবা তৃতীয় বিশ্ব সব জায়গাতেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা প্রশ্ন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও প্রগতিশীলতার পুরানো বয়ানে এখন আর মানুষের আস্থা নেই। তত্ত্ব ও রাজনৈতিক কথামালার ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে মানুষকে প্রতারিত করার কৌশল এখন অকেজো হয়ে পড়েছে। মার্ক্স প্রগতিশীল, পুঁজিবাদে মুক্তি, মোহাম্মদ সেকেলে মানুষ এসব কথা আর মানতে রাজি নন। মানুষ এখন তার প্রাপ্যটা বুঝে নিতে চায়, কথা ও কাজে মিল দেখতে চায়। ইসলামফোবিয়া এখন আর কার্যকর কিছু নয়। নানা প্রপাগা-ার কুজ্ঝটিকায়ও মানুষ এখন উপলব্ধি করতে পারছে ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, বরং একটি ধর্ম-দর্শন। শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাস জেনে মানুষ এখন মুগ্ধ। তাইতো চিন্তা ও দর্শনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নতুন বয়ান। বয়ানে কিছু তারতম্যও আছে। নতুন প্রেক্ষাপটে, নতুন পথচলায় মতবৈচিত্র্যের বাতাবরণেও একটা যৌক্তিক সময়ে লক্ষ্য করা যাবে কাক্সিক্ষত ঐক্য ও পরিবর্তন।

৯ নভেম্বর প্রকাশিত এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয় নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর জন্য নগর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে মুদি দোকান চালানো, বিনামূল্যে গণপরিবহন এবং শিশু পরিচর্যার মতো নীতির প্রচার চালিয়ে জোহরান মামদানি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এমন গণবান্ধব ও প্রগতিশীল কর্মসূচি গ্রহণ করার পরও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী কিছু ব্যক্তির নিশানায় পড়ে গিয়েছিলেন। ফোবর্সের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ২৬ ধনকুবের ও ধনি পরিবার সম্মিলিতভাবে মামদানির প্রতিপক্ষকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যযের জন্য ২ কোটি ২০ লাখ ডলার তথা প্রায় ২৬৮ কোটি টাকা প্রদান করেছেন। কিন্তু এর কারণ কী? ধনকুবেররা বলেছেন, মামদানি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করছেন। অথচ মামদানির কর্মসূচিতে তো তেমন কিছু নেই। বরং আছে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর মতো কর্মসূচি। সাধারণ মানুষের কল্যাণ-কর্মসূচি যদি যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবেরদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে উপলব্ধি করা যায় দেশটির রাজনীতি, অর্থনীতি কেমন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেটা নিশ্চয়ই গণবান্ধব ভিত্তি নয়, এখানে পরিবর্তন প্রয়োজন। এমন আকাক্সক্ষা থেকেই নিউইয়র্কের নাগরিকরা বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন জোহরান মামদানেিক। মামদানির বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়Ñ তিনি একজন মুসলিম, গণতন্ত্রী এবং পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সাম্যবাদি। তবে এ কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে সন্ত্রাসী ও কম্যুনিস্ট ঘরানার মানুষ আখ্যা দিয়ে যেভাবে নিন্দা করতে চেয়েছেন, তার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এতে ট্রাম্পের নৈতিক পরাজয়টাও সম্পন্ন হয়েছে।

ট্রাম্পেরও একটি ঘরানা আছে। আর তাহলো দম্ভ ও শক্তি প্রয়োগের ঘরানা। এখানে ন্যায় ও মানবিক বোধ কাজ করে না। গাজা তার বড় প্রমাণ। মহান স্রষ্টা মানববান্ধব করে এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এজন্য সব মানুষ বিশেষ করে শাসকদের স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু এর বদলে ট্রাম্পের মত কিছু দাম্ভিক মানুষ নিজেরাই পৃথিবীর প্রভু হয়ে উঠেছেন। স্রষ্টার বিধানকে লঙ্ঘন করে মারণাস্ত্রের জোরে পৃথিবীতে তাড়া এক ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ভুরাজনীতি খুবই স্পষ্ট এবং আগ্রাসী। দেশের অভ্যন্তরীণ যে রাজনীতি, সেখানেও ট্রাম্প বেশ আগ্রাসী। দেশের ভেতর কেউ মজলুম ফিরিস্তিনীদের পক্ষে কথা বললে, কিংবা যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে ট্রাম্প প্রশাসনের রোষানলে পড়তে হয়। একই কারণে রোষানলে পড়তে হয়েছে জোহান মামদানিকেও। এক অদ্ভূত মানুষ ট্রাম্প।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর দেশটির একটি সিটির মেয়র হয়েছেন জোহরান মামদানি। তুলনা করতে গেলে বলতে হয়, দু’জনের মধ্যে পার্থক্য বা ব্যবধানটা অনেক অনেক। একজন গোটা দেশের প্রেসিডেন্ট, অন্যজন একটি সিটির মেয়র পদে বিজয়ী হলেন মাত্র। কিন্তু মামদানির বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে, যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে মনে হয় যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বড় কিছু ঘটে গেছে। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে মার্কিন জনমনে এক ধরনের মিথ তৈরি হয়েছে। মিথটি হলো-‘ট্রাম্প সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।’ কিন্তু ট্রাম্পের স্পষ্ট বিরোধিতার পরও নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্র্যাট ও মুসলিম জোহরান মামদানির ভূমিধস বিজয় সেই মিথে প্রবল আঘাত হেনেছে। ট্রাম্পের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের প্রতি ছুঁড়ে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির মাঠে ট্রাম্পকে বিপদে ফেলতে পারে। এ কারণেই জোহরান মামদানির বিজয়কে বিশ্লেষকরা একটি বড় ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে দেশ শাসন করছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল তাকে থামানোর মতো কেউ নেই। ট্রাম্প তার ক্ষমতাবলে এমন অনেক কাজ করেছেন, যা আইন ও রাজনীতির মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না। তিনি অনেককিছুতেই অতিরিক্ত মাত্রায় নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ করেছেন। গত এক বছর ধরে রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকা ডেমোক্র্যাটদের বড় ধরনের জয় হয়েছে মঙ্গলবার রাতে। নিউইয়র্কের মেয়র ছাড়াও ভার্জিনিয়া ও নিউ জার্সির গভর্নর পদে বিজয়ী হয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা। আর এ জয়ের পরপরই ট্রাম্পের জরুরি শুল্ক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। শুধু তা-ই নয়, তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের সুযোগ দেবে না সংবিধান-এ বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্পর্কে। উল্লেখ্য, গত বছরের একই দিনে ভার্জিনিয়া ও নিউজার্সিতে ট্রাম্প ও তার ‘মেগা’ রিপাবলিকানরা জয়ী হলেও এবার হয়েছে ভরাডুবি। আর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছেন প্রত্যাশার চেয়েও বড় সাফল্য।

মেয়র নির্বাচনের আগে ও পরে জোহরান মামদানিকে নিয়ে ট্রাম্প এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে যায় না। তিনি বলেছেন, মামদানি বিজয়ী হলে নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেবেন। এমন কথা বলেছেন নির্বাচনের ঠিক আগের দিন। আর জয়ের পর বলেছেন, নিউইয়র্কে মামদানির জয়ে সামান্য হলেও সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে আমেরিকা।

এমনকি মামদানির জয়ে নিউইয়র্ক কমিউনিস্ট শহরে পরিণত হবে বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প। তার মতে, এই শহর পরিণত হবে কমিউনিস্ট কিউবা এবং সমাজতান্ত্রিক ভেনেজুয়েলায়। ফলে ফ্লোরিডায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে নিউইয়র্কবাসী। এদিকে নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি জানিয়েছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে একসঙ্গে কাজ করার উপায় নিয়ে ট্রাম্পের সাথে আলোচনা করতে চান তিনি। মামদানির বক্তব্য খুবই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। আর এখানে বলে রাখা ভালো যে, জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে, দরিদ্র মানুষের মুক্তি নিয়ে কথা বললেই কোনো রাজনীতিবিদ কমিউনিস্ট হয়ে যান না।

পহেলা জানুয়ারি মেয়র পদে শপথ নেবেন জোহরান মামদানি। এটি নিউইয়র্ক সিটির ঘটনা হলেও সারাদেশেই এর একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রভাবটা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশি। লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম, পৃথিবীটা কি পরিবর্তনের মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে? তেমন ইঙ্গিত তো যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মামদানির বিজয় দেশটির ইহুদি ডেমোক্র্যাট ভোটারদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করেছে। গতানুগতিক ইহুদি ডেমোক্র্যাট ভোটার আর তরুণ সচেতন ভোটারদের মধ্যে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি ইসলাইলের বাইরে বিশে^র বৃহত্তম ইহুদি অধ্যুষিত শহর নিউইয়র্কের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। উল্লেখ্য, ৩৪ বছর বয়সি মামদানি নিউইয়র্কের সাবেক ডেমোক্র্যাট গভর্ণর অ্যান্ড্রু কুত্তমোকে সহজেই পরাজিত করেছেন, যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের কারণে মামদানির বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। তবে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ বহু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ ইহুদি ভোটারদের সমর্থন পেয়েছেন মামদানি। গত বসন্তে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনে প্রকাশ্য সমর্থন মামদানির রাজনৈতিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে।

নিউইয়র্ক সিটিতে ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মেয়র নির্বাচনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ইহুদি ভোটার জোহরান মামদানিকে সমর্থন করেছিলেন। এক্সিট পোল দেখিয়েছে, এটা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরাইলপন্থি ভোট ব্যাংকের জন্য এক বড় ধাক্কা। ধাক্কাটা আসলে আরও আগে লেগেছিল, তবে সেটা মনোজগতে। তরুণদের মনোজগতের ধাক্কাটা ছিল গভীর। মানুষ কতকাল নিজের আত্মার ধ্বনিকে অস্বীকার করতে পারে? তারুণ সবসময়ই আত্মার ডাকে সাড়া দেয়, তবে যাদের আত্মা অসুস্থ, তাদের কথা আলাদা। যুগে যুগে আত্মার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তরুণরা দেশে দেশে পরিবর্তন এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এবার তা লক্ষ্য করা গেছে। জোহরান মামদানি সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশেও। এখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্র-জনতা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা গেছে ডাকসু নির্বাচনেও। আত্মা জীবন্ত থাকলে মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই। এমন মানুষদের মোকাবিলায় সব অন্যায়-অবিচার, জুলুম পরাভূত হতে বাধ্য। পৃথিবীর সব বিপ্লবী আজ যেন এক মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে।