ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র আঘাতের শঙ্কায় তাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা। ইতোমধ্যে প্রবল জোয়ারের পানিতে পাইকগাছার বেশ কয়েকটি স্থানে পানি রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়রায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। শুক্রবার ভোরে কয়রা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের ১৩-১৪/ ২ নম্বর পোল্ডারের পাঁচটি স্থানের ৩০০ মিটার নদে ধসে পড়ে। এই ভাঙনে হুমকিতে পড়েছে বাঁধসংলগ্ন হরিণখোলা, ২ নম্বর কয়রা, গোবরা, ঘাটাখালী, মদিনাবাদ গ্রামসহ কয়রা উপজেলা সদরের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে খুলনায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে খুলনার কিছু কিছু এলাকার নদ-নদীর পানি বাড়ছে।
শুক্রবার (৩০ মে) দুপুরে পাইকগাছার শান্তা এলাকার শাফায়াত হোসেন জানান, পাইকগাছার ফকিরাবাদ ও হড্ডার পাশের বাঁধ ভাঙছে। স্থানীয়রা বাঁধ সংস্কার করছেন। রাস্তার ওপর দিয়ে পানি যাচ্ছে। দাকোপ ও কয়রাসহ উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নদ-নদীতে পানির চাপ আরও বাড়লে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. মিজানুর রহমান জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে খুলনায় বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
কয়রা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে রাতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদে অন্তত ৪ ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার হয়। শুক্রবার ভোরে ভাটার টানে পানি নামতে শুরু করলে কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী বেড়িবাঁধে হঠাৎ ফাটল ও ধসের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় লোকজনের চোখের সামনে ভাঙনরোধে পাউবোর দেওয়া জিও ব্যাগ ও বড় বড় মাটির খন্ড নিয়ে বেড়িবাঁধের ৩০০ মিটার অংশ মুহূর্তেই নদে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙনরোধে অবিলম্বে পাউবোর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ফসলি জমিসহ অসংখ্য মাছের ঘের নদে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।
কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের যে কয়টি স্থান ধসে গেছে, এর সব জায়গায় মাটি সরে গিয়ে মধ্যের বালু বেরিয়ে গেছে। ওই বালুতে পানির ঢেউ লেগে ধুয়ে যাচ্ছে। নদের পানির গতিপথ পাল্টে বেড়িবাঁধের গায়ে আছড়ে পড়ছে। ধসে যাওয়া স্থানগুলোয় সংস্কারের চেষ্টা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কেউ পাশ থেকে মাটি কেটে ধসে যাওয়া স্থানে ফেলছেন, আবার কেউ বাঁধের ঢাল থেকে জিও ব্যাগ তুলে ধসে যাওয়া বাঁধের স্থানে দিচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজ শেখ মাটি কেটে বাঁধের ধসে পড়া স্থানে দিতে দিতে বললেন, ‘আমরা কাছের বাসিন্দারা বাঁধ রক্ষায় আগাই না আসলি এ বাঁধ বানতি অনেক দেরি হবে। তখন এলাকায় আর বাস করবার মতো পরিস্থিতি থাকবে না। বাঁধ মেরামত যাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তারা কেউ সময় থাকতি এগোয় না। যত মরণ আমাগের মতো খাইটে খাওয়া মানুষের।’
হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুল মোল্লা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। অথচ এরই মধ্যে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নির্মাণের সময় ওপরে এবং বাঁধের দুই পাশে মাটি দেওয়া হলেও ভেতরে বালু দেওয়া হয়। এ কারণে দুর্বল হয়ে এখন একটু জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ধসে যাচ্ছে। বাঁধ যাতে না ভাঙে, সে জন্য নদের তীরে পাকা ব্লক দেওয়া দরকার।
কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী গোবরা গ্রামের স্কুল শিক্ষক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘হরিণখোলা গ্রামের পাশের ওই বাঁধকেই বলা হতো কয়রার সবচেয়ে মজবুত বেড়িবাঁধ। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যায়ে ২০২১ সালে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে সেখানে যত বড় প্রকল্প ছিল, কাজ তত ভালো হয়নি। অধিকাংশ স্থানে বাঁধের দুই পাশ ও ওপরে মাটি দিয়ে ভেতরে বালু দেওয়া হয়। এ কারণে বাঁধ দুর্বল হয়ে ধসে যাচ্ছে। আজ (শুক্রবার) সকাল থেকে ভাঙনের পরিধি বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না।’
খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে নিম্নচাপের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ার বেড়েছিল। কয়রার হরিণখোলা এলাকার বেড়িবাঁধে ধস এবং চৌকুনি এলাকায় কয়রা নদীর বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছিল। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ভাঙনকবলিত স্থানে উপসহকারী প্রকৌশলীরা পরিদর্শন করেছেন। আপাতত ভাঙনের পরিধি যাতে না বাড়ে এ জন্য বাঁধের গায়ে জিও ব্যাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থায়ী সমাধানের জন্য ঠিকাদারের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ শুরু হবে।
এদিকে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ও অমাবস্যার কারণে করমজল, দুবলার চর, কটকা, কচিখালী, শেলার চরসহ বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সুন্দরবনে স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে তিন ফুট পানি বেড়েছে। তবে করমজল ও অন্য কোনো এলাকার বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়নি। এছাড়া বনের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য উঁচু টিলা তৈরি করা আছে। পানি বাড়লে ওই সব টিলায় বন্যপ্রাণী আশ্রয় নিতে পারবে।
অন্যদিকে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বাগেরহাট পৌরসভার রাহাতের মোড়, পুরাতন বাজার, কাঁচাবাজার, মোরেলগঞ্জ পৌরসভার প্রধান বাজার, বিভিন্ন সড়ক, মোংলা শহরের বেশিরভাগ এলাকাসহ জেলার নিম্নাঞ্চল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে দরাটানা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বলেশ্বর নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁয়েছে এবং পশুর নদীর পানি ১.১৫ মিটার ওপরে রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে জোয়ারের সময় স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে আড়াই ফুট পানি বেড়েছে।
উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মো. আল বিরুনী বলেন, নদ-নদীর পানি বাড়লেও, জেলার কোথাও বেড়িবাঁধ ভাঙার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত চালু থাকলেও মোংলা বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক (বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগ) মো. মাকরুজ্জামান। তিনি বলেন, তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত জারি থাকলেও আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে রয়েছে। ফলে মোংলা বন্দরে পণ্য খালাস ও পরিবহন কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে।