আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : অনুকূল মাটি ও জলবায়ু, এককালীন বিনিয়োগে তুলনামূলক বেশি লাভ, উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের বিশাল স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষাবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর ও মেহেরপুরের মতো ঐতিহ্যবাহী আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোয়। এমনকি সমতল থেকে পাহাড়ি অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমবাগান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে দেশে আমের আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, যা এই খাতের অপার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন এই সুমিষ্ট ফল রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ভূমিকা রাখছে। আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশের আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, কিন্তু তারা সে তুলনায় রপ্তানি করতে পারছেন না। ফ্রান্স ও ইতালিতে শুধু বাংলাদেশী নয়, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের মানুষও বাংলাদেশের আম পছন্দ করেন। তবে আম বিদেশে পাঠানোর পথে পচন ধরে যাওয়ার ভয় থাকে, তাই পচন রোধে প্রাকৃতিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন রপ্তানিকারকরা।

এবার রপ্তানি বাণিজ্যে যোগ হচ্ছে নতুন ও সম্ভাবনাময় বাজার চীন। ইতোমধ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের ‘উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণযোগ্য আমের বাগান’ পরিদর্শন করে গেছেন এবং বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন আম কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এটি সফল হলে বাংলাদেশের আম রপ্তানিতে নতুন মাইলফলক যুক্ত হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও টাঙ্গাইল - এই ৯টি প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলায় চলতি বছর প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ১৩ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ আমের বাজারমূল্য এবার প্রায় ১৫ হাজার ২১ কোটি টাকা হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চাষি, ব্যবসায়ী এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

চলতি মৌসুমে শুধু রাজশাহী অঞ্চলে আম চাষকে ঘিরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজশাহী জেলা প্রশাসন ঘোষিত ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, গোপালভোগ আম ২২ মে থেকে সংগ্রহ করা যাবে। লকনা, লক্ষণভোগ ও রানীপছন্দ আম পাড়া যাবে ২৫ মে থেকে। এছাড়া হিমসাগর ও ক্ষীরশাপাত ৩০ মে, ল্যাংড়া ও বানানা ম্যাংগো ১০ জুন এবং আম্রপালি ও ফজলি আম ১৫ জুন থেকে সংগ্রহের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সাতক্ষীরার সুস্বাদু আম এবছর ও বিদেশে যাচ্ছে। এবার জেলাতে ৪ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১২০ মেট্রিক টন বাছাই করা আম ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম জানান, সলিডারিডাড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৬ সাল থেকে সাতক্ষীরার আম বিদেশে যাচ্ছে। নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চলে চলতি মৌসুমে ৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখছেন আম সংশ্লিষ্টরা। নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বছর জেলায় ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আমের চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ আশা করছে এখান থেকে ৩ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে। সে হিসাবে এ বছর নওগাঁ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। নওগাঁর প্রায় ৩০ লাখ মানুষের আমের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন। বাকি প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন আম দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখছেন আম সংশ্লিষ্টরা। জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ও সুস্বাদু আম বাজারে উঠতে শুরু করবে। এ বছর জেলায় প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্য হতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী জানান, জেলার ৫টি উপজেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে নানা জাতের প্রায় ৮ লাখ ৫২ হাজার ৪৯০টি আম গাছ রয়েছে।

এদিকে সাতক্ষীরার আম এখন একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কারণ সবার আগে সাতক্ষীরার আম পাকা শুরু হয়। স্থানীয় কৃষকদের পরিশ্রম, সরকারের তত্ত্বাবধান এবং বিদেশী চাহিদার সমন্বয়ে আম চাষ এখন জেলার অন্যতম অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। চলতি মৌসুমে সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা ও কেমিকেলমুক্ত বিপণনের মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা আম পাবে নতুন উচ্চতা, এমনটাই প্রত্যাশা জেলাবাসীর। দাম কম পেলেও ৪০০ কোটি টাকা বিক্রির স্বপ্ন দেখছে সংশ্লিষ্টরা। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, চাষিরা দাম বেশি পাওয়ার আশায় একসঙ্গে আম পেড়ে ফেলেছেন। নিয়ম হচ্ছে একটি গাছ থেকে চারবারে আম পাড়তে হবে। কিন্তু চাষিরা একসঙ্গে সব আম পেড়ে বাজারজাত করায় দাম কমে গেছে।

সঠিক পরিচর্যা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং রপ্তানি প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারলে বাংলাদেশের আম বিশ্ববাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে এবং এটি দেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী কৃষিপণ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।