প্রায় ২০০ বছর ধরে নির্ঘুম ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে যাচ্ছে
মোঃ জুবায়ের হোসেন, নাটোর : প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অপরূপ নিদর্শন নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজ প্রাসাদ বা উত্তরা গণভবন। ঐতিহ্যের জৌলস, অতীতের রাজ-রাজন্যের স্মৃতি, প্রাচীনত্ব আর ইতিহাসের সোনালি দিনগুলোকে বুকে ধারণ করে কালের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা টি। রাজপ্রাসাদের সামনে এলে সবাইকে থমকে যেতে হয় এর দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহ দুয়ার দেখে। সেই দুয়ারের ওপর অতিকায় শোভা পাচ্ছে এক ঘড়ি। যুগের সাক্ষী হয়ে এ ঘড়ি প্রায় ২০০ বছর ধরে নির্ঘুম ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে আজও সঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে। মহারাজা রামজীবন ও রানী ভবানীর দেওয়ান দয়ারাম রায় এই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। দয়ারাম রায় ছিলেন তিলি সম্প্রদায়ের। রানী ভবানী বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে তাঁকে দয়ারামপুর এস্টেট ও দিঘাপতিয়া তালুক দান করেন। নাটোর শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে ১২৫ বিঘা জমির ওপর আঠারো শতকে নির্মিত রাজপ্রাসাদটি। সুউচ্চ প্রাচীর ও পরিখার বেষ্টনী। দেশি-বিদেশি দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষরাজি। ইটালিয়ান গার্ডেনে শোভা পাচ্ছে শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য। রাজপ্রাসাদে রয়েছে ছোট-বড় কয়েকটি কামান। মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্বকালে যশোরের মুহম্মদপুরে রাজা সীতারাম বিদ্রোহ করলে দয়ারাম রায় নবাব সৈন্যের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেন এবং সীতারামকে পরাজিত ও বন্দি করে নাটোরে নিয়ে আসেন। নবাব তাঁকে এ সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে একটি তালুক দান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি এই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১০ সালে দয়ারাম রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে জগন্নাথ রায় রাজা হন। এরপর তাঁর ছেলে প্রাণনাথ রায় রাজা হন। নিঃসন্তান প্রাণনাথের মৃত্যুর পর দত্তক পুত্র প্রসন্ন নাথ রায় রাজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশভাগের সময় এই রাজবংশের উত্তরাধিকাররা ভারতে চলে যান। এর পর ষাটের দশকে এটিকে গবর্নর হাউস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭২ সালে গবর্নর হাউস থেকে উত্তরা গণভবন নামকরণ করা হয়। ঢাকার বাইরের এই একটি মাত্র স্থাপনায় আগে মন্ত্রিসভার বৈঠক হলেও এখন আর হয় না। সর্বশেষ ১৯৯৬সালে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছিল। সংরক্ষিত এই উত্তরা গণভবনের রাজপ্রাসাদ ও ইটালিয়ান গার্ডেন অংশটুকু বাদে বাকি সব স্থাপনা ও চত্বর ২০০৯ সাল থেকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে চালু করা হয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা ও সংগ্রহশালা। রোববার ছাড়া প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। মূল ফটকে প্রবেশমূল্য সিনিয়র সিটিজেন ১০টাকা, শিক্ষার্থী এবং দলগত জনপ্রতি ২০টাকা, সাধারণ ৩০টাকা, বিদেশি নাগরিক ৬০০টাকা আর সংগ্রহশালায় প্রবেশমূল্য ৩০টাকা। বছরজুড়ে এখানে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ লাখ দর্শনার্থী আসেন এই স্থাপনা পরিদর্শনে। বিদেশি নাগরিক আসেন ১৪৩ জন। উত্তরা গণভবনের হিসাব সহকারী নুর মোহাম্মদ জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে টিকিট বিক্রি এবং গাড়ি পার্কিং খাত থেকে তাদের আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা।
রাজপ্রাসাদ নির্মাণঃ মহারাজা রামজীবন ও রানী ভবানীর দেওয়ান দয়ারাম রায় এই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭০৬সালে রানী ভবানী বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় জমিদারি লাভ করেন। এরপর দুইশ বছরের অধিক সময় ধরে বগুড়া, পাবনা, জামালপুর ও যশোর জেলার অংশবিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে শাসন করেছে এই রাজবংশ। ১৭৩৪সালে প্রায় ৪৩একর জমির ওপর দিঘাপতিয়া প্রাসাদের মূল অংশ ও এর সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেন। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭সালের ১০জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে যোগ দেন। কিন্তু অধিবেশনের শেষদিন ১২জুন প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পওে ১৮৯৭থেকে ১৯০৮সাল পর্যন্ত ১১বছরের চেষ্টায় বিদেশি প্রকৌশলী চিত্রকর্ম শিল্পীদের সহায়তায় ৪১.৫০একর জমির ওপর প্রমদানাথ রায় মোগল ও প্রাশ্চাত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক কারুকার্য খচিত রাজপ্রাসাদটি পুনর্র্নিমাণ করেন। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন। জনশ্রুতি রয়েছে, রাজা প্রমদানাথ রায়ের ঘড়ি ও বাড়িপ্রীতি ছিল। তিনি বিদেশ থেকে নানা ধরনের ঘড়ি তৈরি করে এনে প্রাসাদের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করতেন। দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহ দুয়ারের অতিকায় ঘড়িটিও বিদেশ থেকে এনে স্থাপন করা হয়। ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে ঘড়িটি আনা হয়ে ছিল। উত্তরা গণভবনের প্রায় ১৩কিলোমিটার দূরের গ্রাম ছাতার ভাগের বাসিন্দা সাবেক উপজেলা ভাইচ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মওলানা ড. মোঃ জিয়াউল হক বলেন, নব্বইয়ের দশকে বাড়ি থেকে রাজবাড়ির এই ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শোনা যেত। কয়েক বছর আগে ঘড়িটি একবার মেরামত করতে হয়। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের সহায়তায় ঘড়িটির কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজনের পর ঘড়িটি আবার সময় দিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন দূর থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায় না । নাটোরের জেলা প্রশাসক এবং উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আসমা শাহীন বলেন, ঐতিহ্য-স্থাপত্যের উত্তরা গণভবনের সব সংস্কার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনায় হওয়া উচিত। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত¦াবধানে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই মাস্টারপ্ল্যানের অধীনে এই ঐতিহ্যকে সুরক্ষা প্রদান করা হবে।