ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় ইসরাইলের নৃসংশ গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছে। পালন করেছে নানা কর্মসূচী। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এ হত্যাকান্ড বন্ধে পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মধ্যেই ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় দফায় দফায় হামলা করে গণহত্যা চালাচ্ছে দখলদার ইসরাইল। গত কয়েক দিন ধরে দেশটির বর্বরতার মাত্রা অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই গণহত্যা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এবার বাংলাদেশেও একযোগে আন্দোলন শুরু হয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশ ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে।

গতকাল সোমবার বিশ্বব্যাপী ‘নো ওয়ার্ক নো ক্লাস’ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এছাড়া সর্বসাধারণ গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন। গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মাঠে নেমেছেন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে রাজধানী ঢাকা যেন পরিণত হয়েছে বিক্ষোভের নগরীতে। দেশের বিভিন্ন স্থানেও একযোগে পালিত হচ্ছে অভিন্ন কর্মসূচি। যে যার মতো করে ব্যানার, ফেস্টুন হাতে নিয়ে অংশ নিচ্ছেন মিছিলে। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী দখলদার বাহিনীর অব্যাহত গণহত্যা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বিবৃতিতে ফিলিস্তিনে নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন এবং বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা ও অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকে ইসরাইলী সামরিক হামলায় বহু ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এর ফলে গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গেছে, যা বাসিন্দাদের মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্পষ্টত, ইসরাইল বারবার আন্তর্জাতিক আবেদনের তোয়াক্কা করেনি, বরং ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে।

গতকাল বাদ জোহর ঢাকার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে একাধিক ইসলামী দল ও আলেম-ওলামাদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদী মিছিল বের করে। মিছিল থেকে জায়নবাদী ইসরাইলের বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয়। অবিলম্বে এই বর্বরতা বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়। এর আগে সকালে বেসরকারি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্মরণকালের সেরা প্রতিবাদ মিছিল করে। বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো মিছিল অব্যাহত আছে। এতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে অংশ নেন। স্লোগান দেন দখলদার ইসরাইলের গণহত্যা বন্ধের দাবিতে।

এদিকে বিকেলে শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বড় আকারে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ পালন করা হয়েছে।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে গতকাল সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সবার মুখে মুখে গাজাবাসীর জন্য সমবেদনা ও ইসরাইলের প্রতি ক্ষোভের স্লোগান শোনা যায়।

এর বাইরেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর জায়গায় কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা।

ঢাবিতে বিক্ষোভ

গাজায় ইসরাইলী গণহত্যার প্রতিবাদ ও ‘গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা’র সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে সংহতি সমাবেশ করেছে ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল অবস্থান নেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাদের সঙ্গে সংহতি জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল। এ ছাড়াও বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মার্চ ফর প্যালেস্টাইনের ডাক দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

গতকাল সোমবার সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেন ও ফিলিস্তিনে ন্যায়বিচারের দাবিতে নানান স্লোগান দেন। সকাল থেকেই বিক্ষোভকারীদের নানান স্লোগানে মুখরিত ছিল ক্যাম্পাস। স্লোগানের মধ্য দিয়ে ইসরাইলী দখলদারিত্বের অবসান ও ফিলিস্তিনের মানুষের সঙ্গে সংহতির কথা উঠে এসেছে।

শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের পতাকা এবং ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে সংহতি সমাবেশে যোগ দেয়।

ঢাবি শিক্ষার্থী তামিম আহসান জানান, ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী জনগণের ডাকা বিশ্বব্যাপী ধর্মঘটের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে আয়োজিত আজকের সমাবেশে ছাত্রছাত্রী এবং সমাজের সকল স্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেন এবং দখলদার ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

শিক্ষার্থীরা সরকারকে জাতীয়ভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সমগ্র বিশ্বের আহ্বান উপেক্ষা করে আমেরিকার সমর্থনে ইসরাইলের আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে, প্রতিদিন শত শত শিশু ও নারীকে হত্যা করা হচ্ছে। এই পৈশাচিক কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকেও জাতীয় ভিত্তিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাবো।

ফারুক হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী জানান, ইসরাইল একটি অবৈধ রাষ্ট্র এবং বিশ্ব ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে জঘন্য ও বর্বর গণহত্যার অপরাধী। নিরীহ শিশু ও মানুষ হত্যার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলকে সামরিক এবং আর্থিক সহায়তাসহ সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে।

আরব দেশগুলোর নেতাদের দোষারোপ করে তিনি বলেন, আরব বিশ্বের নেতারা ইসরাইলের পালিত দাস। যখন বিনা কারণে ফিলিস্তিনে তাদের ভাই বোনদের ওপর বোমা হামলা হচ্ছে তখন তারা আনন্দে মগ্ন। গাজার জনগণের প্রতি যদি তারা সামান্য সাহায্যও করত, তাহলে ইসরাইল এমন গণহত্যা করার সাহস পেত না।

আরব দেশগুলোকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আরব দেশগুলো এখনও ইসরাইলকে সমর্থনকারী পশ্চিমা ব্লকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। আরব দেশগুলো এখন ‘আরব-ইসরাইল’ সংঘাত সমাধানের জন্য ইসরাইলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবিত ‘আব্রাহাম অ্যাকোর্ড (চুক্তি) এর উপর ঝুঁকে পড়ছে, যা মানবতা এবং ফিলিস্তিনীদের প্রতি স্পষ্ট অবমাননা।

এদিন বিক্ষোভকারীরা অবমাননার প্রতীক হিসেবে ইসরাইলী পতাকা, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূর্তিও পুড়িয়েছে।

ঢাবি ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করেছে এবং অফিসিয়াল কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে বিশ্বব্যাপী ধর্মঘটের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজ সকল ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করেছে এবং অফিসিয়াল কাজ দুই ঘণ্টার জন্য বন্ধ রেখেছে।

বিএসএমএমইউ-এর ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত

পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি নোটিশ জারি করে ‘বিশ্বব্যাপী ধর্মঘট ও সংহতি কর্মসূচির’ সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে। এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বুয়েটের প্রতিবাদ :

এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সকাল সাড়ে ১১ টায় বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে একটি মানববন্ধন করেন।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বলেন, গাজায় নিরীহ শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষের উপর যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে তা কেবল রাজনৈতিক সংকট নয়, বরং একটি চরম মানবিক ও নৈতিক সংকট। এমনকি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনা ধ্বংসের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে যা সভ্যতার চরম অবক্ষয়।

‘আমরা, বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান অমানবিক সহিংসতা, নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, বোমা হামলা, রাসায়নিক হামলা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ এবং তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

মানববন্ধন থেকে ‘গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা’র প্রতি সমর্থন জানিয়ে বুয়েটের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরাইলী বাহিনী তাদের দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। দখলদার ইসরাইলী বাহিনী পৌনে এক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু আরব বিশ্ব এবং অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলি নীরব। আমি মনে করি খুব শিগগিরই ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন উঠে আসবে এবং এই উত্থান সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ঐতিহাসিক পরাজয়কে চিহ্নিত করবে।

মহাখালীর ব্র‍্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সকাল থেকে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। স্লোগান আর বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবি জানায় তারা। গাজায় হামলা নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর নিশ্চুপ অবস্থানের সমালোচনা করেন তারা।

বিক্ষোভ চলে ফার্মগেট এলাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সামনে। উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে অবস্থান নেবে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজসহ উত্তরা এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

মিরপুর ১০ নম্বরে বিক্ষোভের ডাক দেয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। সকাল সাড়ে ১১টায় যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তায় শহীদী ঐক্য চত্বরে বিক্ষোভ করবে জুলাই বিপ্লব পরিষদ। এ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন সর্বস্তরের ছাত্র জনতা। এ সময় তাদের ইসরাইল বিরোধী নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়।

ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ধর্মঘট পালন করছে বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা গাজায় মুসলিমদের ওপর হওয়া গণহত্যার বিচারের দাবি জানান। কর্মসূচিতে যোগ দেন রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও।

ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ‘মার্চ ফর প্যালেস্টাইন’ কর্মসূচি পালন করছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এছাড়া, গাজাবাসীর প্রতি সংহতি জানিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার দাবিতে গণজমায়েত হচ্ছে রংপুরে। জেলা স্কুল মোড়ে এ কর্মসূচিতে যোগ দেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এসব কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, দ্রুত ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা হোক। আর যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তারা।

হেফাজতের সমাবেশ

ফিলিস্তিন আজ একটি কবরখানায় পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি মামুনুল হক। তিনি বলেছেন, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল গাজায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা ইতিহাসের সমস্ত নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে। এই জুলুমের নেপথ্য কারিগর হচ্ছে আমেরিকা।

গতকাল সোমবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি।

মামুনুল হক বলেন, আমেরিকার প্রত্যক্ষ সমর্থন ও অস্ত্রসজ্জায় ইসরাইল বারবার ফিলিস্তিনীদের রক্তে হোলি খেলছে। আমেরিকা নিজেকে মানবাধিকারের রক্ষাকর্তা দাবি করলেও আজ তাদের মুখোশ খুলে গেছেÑ তারা জায়োনিস্ট সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক।

তিনি বলেন, ইসরাইল শুধু একটি অবৈধ রাষ্ট্র নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি ক্যান্সার। এ ক্যান্সারের মূলোৎপাটন এখন সময়ের দাবি। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরজ হয়ে গেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াই ছাড়া মুক্তি নেই।

সংহতি সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের অন্যান্য নেতারা বলেন, ফিলিস্তিন কেবল ইতিহাস নয় এটি মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন। এই ভূমিকে আল্লাহ পবিত্র আখ্যা দিয়েছেন। এখান থেকেই নবীজি (সা.)-এর ইসরা ও মেরাজ শুরু হয়েছিল। এই মোবারক ভূমিকে ধ্বংস করতে ইসরাইল যতই চেষ্টা করুক, সফল হবে না।তারা বলেন, ইহুদিদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। রাসুল (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেনÑ একদিন মুসলমানদের একটি দল এই দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে। ইনশাআল্লাহ, সেই দিন আর বেশি দূরে নয়। ফিলিস্তিন হবে বিজয়ীদের ভূমি, আর ইসরাইলের কবরও সেখানেই রচিত হবে।

এ সময় বক্তারা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে ইসরাইল ও তার মিত্র সব রাষ্ট্রের পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান।

ভারত প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার একের পর এক মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে। ওয়াকফ সম্পত্তি আইনের সংশোধনের মাধ্যমে দেশটির মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোর ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। হেফাজতে ইসলাম এরও তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী, অর্থ সম্পাদক মনির হোসাইন কাসেমী, মুফতি হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী, মাওলানা ফয়সাল আহমাদ, মাওলানা হোসাইন আকন্দ, মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মাসউদ খান, মাওলানা হাকীম আজহারুল ইসলাম নোমানী প্রমুখ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হেফাজতের পল্টন জোন সভাপতি ও দিলু রোড মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি সালাউদ্দীন। সমাবেশ পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলী হামলা বন্ধের দাবিতে একই কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র শিবিরসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। এদিকে শিক্ষার্থীদের ডাকা কর্মসূচিতে একাধিক বিশ্বিবদ্যালয়, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একাত্মতাও জানানো হয়েছে। গাজাবাসীর ওপর বর্বরতার প্রতিবাদে শুক্রবার বিএনপিপন্থী সংগঠন সবার আগে বাংলাদেশ আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের কনসার্টের তারিখ একদিন পেছানো হয়েছে।

জানা যায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামায় ১১৩৯ জন নিহত হন। ওই সময় ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দিনই গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে গাজায় ইসরাইলী যুদ্ধে অর্ধ লক্ষেরও বেশি ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা এক লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। যুদ্ধ থামাতে গাজা-ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সমঝোতা হলেও গত ১৮ মার্চ তা ভঙ্গ ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে দখলদার দেশ ইসরাইল। বোমা হামলার পাশাপাশি স্থল অভিযানও চালাচ্ছে ইসরাইল।

ইসরাইলের চলমান এই গণহত্যার প্রতিবাদে সোমবার বিশ্বজুড়ে সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয় ‘দ্য ন্যাশনাল এন্ড ইসলামিক ফোর্সেস ইন প্যালেস্টাইন’। ৭ এপ্রিলের “দ্যা ওয়ার্ল্ড স্টপ ফর গাজা” কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গতকাল ক্লাস বর্জনের ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচির সময় কোনো ক্লাস, ল্যাব, অ্যাসাইনমেন্ট এমনকি কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেন তারা।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইউআইটিএস, ইউনিভার্সিটি অব প্যাসিফিক, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি ঘিরে বাংলাদেশের রাজধানী গতকাল বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।

কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মানুষ গাজায় বছরের পর বছর ধরে চলা ইসরাইলী বর্বরতা বন্ধের আহ্বান জানান।

বেলা ১১টা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে কর্মসূচি পালন করেছে তারা।

রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনে একদল শিক্ষার্থী গাজায় ইসরাইলী হামলা ও গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মোহাম্মদপুর বসিলা ব্রিজের ওপর স্থানীয় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ইসরাইল বিরোধী স্লোগান দিয়ে ওই এলাকা প্রকম্পিত করেছেন।

নতুনবাজারে মার্কিন দূতাবাসের বিপরীত পাশের রাস্তায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন বহু মানুষ। ‘ইসরাইলের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’, ‘ইসরাইলের ঠিকানা এই দুনিয়ায় হবে না’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা।

কর্মসূচি সংহতি প্রকাশ করে মেরুল বাড্ডায় বিক্ষোভ করেছেন বেসরকারি ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সবাই ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতার নিন্দা জানিয়ে দেশটির পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান।