গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যার সূচনা হয়েছিল একটি ‘হানিট্র্যাপ’ থেকে। কোন প্রকার চাঁদাবাজি নয়, নারী ঘটিত সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও ধারণ করায় ওই সাংবাদিককে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করে দুর্বৃত্তরা। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাতেই ঘটনা¯’লের আশপাশে অভিযান চালিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করেছে। বর্তমানে সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের সনাক্তকরণের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় গোলাপি নামের এক নারীকে খুঁজছে পুলিশ। সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার গাজীপুরে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেছে বিভিন্ন সংগঠন।

পুলিশ ও ¯’ানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহষ্পতিবার রাতে গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ের ঈদগাহ মার্কেট এলাকায় গোলাপি নামে এক নারী বাদশা নামের একজনকে প্রলোভনে (হানিট্র্যাপ) ফেলে। তার সঙ্গে থাকা সশস্ত্র যুবকরা বাদশাকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মোবাইলে দৃশ্যটি ধারণ করছিলেন সাংবাদিক তুহিন। এ সময় হামলাকারীরা তার ওপর চড়াও হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ ইতোমধ্যে ঘটনা¯’ল এলাকা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছে।

সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, কালো জামা পরা এক নারী (গেলাপী) রাস্তা দিয়ে হেঁটে যা”েছন। হঠাৎ নীল শার্ট পরা এক ব্যক্তি (বাদশা) ওই নারীকে টেনে ধরে। এসময় চলে যেতে চাইলে ওই নারীর পথরোধ করে এবং এক পর্যয়ে তাকে থাপ্পড় মারে বাদশা। মুহূর্তেই চাপাতি, রামদা ও চাইনিজ কুড়াল কয়েকজন যুবক ওই ব্যক্তির দিকে ধেয়ে আসে এবং তাকে কোপাতে থাকে। লক্ষ্যবস্তু ওই ব্যক্তিটি দৌড়ে ঘটনা¯’ল থেকে পালিয়ে যায়। এ সময় সাংবাদিক তুহিন মোবাইলে ওই দৃশ্য ধারণ করতে থাকলে সন্ত্রাসীদের নজর তার দিকে যায়। তারা সাংবাদিক তুহিনকে ধাওয়া করে। প্রাণ রক্ষার জন্য সাংবাদিক তুহিন দৌড়ে পার্শ্ববর্তী চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ মার্কেটের একটি দোকানে আশ্রয় নেন। ফুটেজে দেখা গেছে, দাঁড়িওয়ালা ও মাথায় ক্যাপ পরা ফয়সাল ওরফে কেটু মিজান চাপাতি হাতে দৌড়া”েছ। তার সঙ্গে শাহজামাল, বুলেট ও সুজনসহ আরও কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য কাজ চলছে।

নিহত তুহিনের সহকর্মী সাংবাদিক মো. শামীম জানান, আমরা দুজন পাশ দিয়ে যা”িছলাম, হঠাৎ দেখি কয়েকজন অস্ত্র হাতে দৌড়া”েছ, তুহিন তখন ভিডিও করতে শুরু করে, এরপর সন্ত্রাসীরা তার দিকে ধেয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে তুহিন একটি দোকানে ঢুকে পড়েন। কিš‘ সন্ত্রাসীরা সেখানে ঢুকেই তাকে নির্বিচারে কুপিয়ে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পুলিশকে খবর দেওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।

হামলাকারীদের মূল টার্গেট বাদশা জানান, ওই মেয়েসহ একটি দল আগে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, এটি একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র, যারা বাসন, ভোগড়া ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সক্রিয়, সিসিটিভিতে ধরা পড়া নারীসহ মিজান ওরফে কেটু মিজান, শাহ জামাল, বুলেট ও সুজন এই চক্রের সক্রিয় সদস্য,

¯’ানীয়রা জানান, চান্দনা চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে এক শ্রেণীর নারী পথচারী বিভিন্নজনকে প্রলোভন দেখিয়ে কাছে ডেকে নেয়। এসময় ওই নারীর সঙ্গে আশেপাশে ওৎপেতে থাকা ধারালো অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এসে ওই ব্যক্তিদের মারধোর করে এবং সর্বস্ব কেড়ে নেয়। প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটলেও ভয়ে ওই ব্যক্তিদের উদ্ধারে কেউ এগিয়ে যায় না। এমনকি আশেপাশে পুলিশ উপ¯ি’ত থাকলেও তারা নিরব দর্শকের ভ’মিকা পালন করে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-সহকারি কমিশনার রবিউল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর জনৈক বাদশা মিয়া গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার বহুতল বিপণী বিতান শাপলা ম্যানশনের সামনে গোলাপি নামের এক মহিলাকে কিল ঘুষি মারছিলেন। এ সময় মহিলার সাথে থাকা কয়েকজন যুবক চাপাতি ও ছুরি দিয়ে বাদশা মিয়ার উপর হামলা চালায়। আহত বাদশা মিয়া ঘটনা¯’ল থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। এসময় মহিলার উপর বাদশাহ মিয়ার হামলা এবং পরবর্তীতে বাদশা মিয়ার উপর সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার দৃশ্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। হামলাকারীরা তুহিনকে ভিডিও ধারণ না করতে বলে এবং ধারণকৃত ভিডিও ডিলিট করতে বলে। এক পর‌্যায়ে আসাদুজ্জামান তুহিন ঘটনা¯’ল থেকে চলে যেতে থাকলে হামলাকারীরা তাকে অনুসরণ করে ধাওয়া করে। তুহিন দৌড়ে পার্শ্ববর্তী ঈদগাহ মার্কেটের চা-পান বিক্রেতা জনৈক রুহুল আমিনের দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা সেখানে গিয়ে জনসম্মুখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে বুকে, গলায়, কাঁধে ও পিঠে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ঘটনা¯’ল থেকে পালিয়ে যায়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার গলার কিছু অংশ কেটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়। এতে ঘটনা¯’লেই নিহত হন তুহিন। এদিকে ঘটনার পর আহত বাদশা মিয়া গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

তিনি জানান, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার ঘটনায় নিহতের বড় ভাই সেলিম মিয়া বাদী হয়ে শুক্রবার অজ্ঞাতদের আসামি করে বাসন থানায় মামলা দায়ের করেছেন। হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার ময়নাতদন্ত শেষে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের লাশ তার বড় ভাই সেলিম মিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুপুরে জুমার নামাজের পর চান্দনা চৌরাস্তার ঈদগাহ মাঠে তার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার বড় ভাই সেলিম মিয়া লাশ গ্রহণ করে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় পারিবারিক গোর¯’ানে দাফনের জন্য নিয়ে যায়। নিহত মোঃ আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৬) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে। তিনি স্বপরিবারে গাজীপুরে থেকে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) রবিউল হাসান বলেন, সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রাতেই ঘটনা¯’লের আশপাশে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হ”েছ। সিসিটিভি ফুটেজের সাথে মিলিয়ে এদের সনাক্তকরণের কাজ চলছে। আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছি যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি এই মামলায় জড়িয়ে না যায়।

তিনি জানান, পুলিশের একাধিক টিম এখনো পলাতক ওই নারী গোলাপিকে এবং চিহ্নিত আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালা”েছ। তিনি আরো বলেন, পুলিশ ও অন্যান্য সং¯’ার গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, এটি একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা বাসন, ভোগড়া ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সক্রিয়। সিসিটিভিতে ধরা পড়া নারীসহ মিজান ওরফে কেটু মিজান, শাহ জামাল, বুলেট ও সুজন এই চক্রের সক্রিয় সদস্য। ঘটনার সময় হামলাকারীদের মূল টার্গেট ছিল বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি, যিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এদিকে বাসন থানা এলাকায় সাংবাদিক তুহিন হত্যা এবং আগের দিন (বুধবার) সদর থানার পাশে আনোয়ার হোসেন নামে অপর এক সংবাদকর্মীকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা আনোয়ারকে নির্মমভাবে মারধর করে এবং তার বুকের ওপর উঠে লাফায়। এসময় ইট দিয়ে তার পা থেঁতলে দেয় এবং টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। ঘটনা¯’লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপ¯ি’ত থাকলেও তারা আশানুরূপ কোনো হস্তক্ষেপ করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।

গাজীপুরে পরপর দুইদিনে সাংবাদিকদের উপর হামলার দুইটি ঘটনার প্রতিবাদে গাজীপুরে সাংবাদিকসহ সকল মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদে ও আইন শৃঙ্খলা অবনতির অভিযোগে শুক্রবার গাজীপুর প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠণ মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ ও অব¯’ান কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে বৃহষ্পতিবার রাতেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর গাজীপুর নগর শাখার নেতা-কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেছে। এছাড়াও গাজীপুর প্রেসক্লাব, জামায়াতে ইসলাম, বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠণ সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও অবিলম্বে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।

প্রতিক্রিয়ায় গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমির ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, জেলা নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুল হাকিম, মাওলানা শেফাউল হক, জেলা সেক্রেটারি শফিউদ্দিন, মহানগর আমির অধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন, মহানগর নায়েবে আমির মোঃ খাইরুল হাসান ও মোঃ হোসেন আলীসহ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “আমরা দাবি জানাই, এই হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক,”

হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও অবিলম্বে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হাসান উদ্দিন সরকার, এছাড়া গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার, সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করিম রনি সহ বিএনপির নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “এটি একটি জঘন্য ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানা”িছ, দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে,”

গাজীপুরবাসীর দৃষ্টি এখন পুলিশের দিকে-প্রশ্ন একটাই, কখন ধরা পড়বে সেই আসল খুনিরা, যারা সত্য তুলে ধরার অপরাধে একজন সাংবাদিককে চিরতরে থামিয়ে দিন?