ফেনী থেকে একেএম আবদুর রহীম : বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। দেশের দক্ষিণের প্রবেশদ্বার ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও সন্দ্বিপ এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা মিলে মোট তিন জেলার ৩৩ হাজার ৮০৫ একর জমি নিয়ে স্থাপিত জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন। এটি ১৩৬.৮০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত যা হবে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল। শুধু তাই নয় এই অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা বিশিষ্ট। বিশ্বের আর কোন শিল্পাঞ্চলে সড়ক, রেল, জল ও আকাশ পথে পণ্য পরিবহনের সুবিধা নেই।
শুরু হয়েছে উৎপাদন : ইতিমধ্যে এখানে ১১টি কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে, ২৮টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এখন পর্যন্ত এখানে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। অব্যাহতভাবে আসছে বিনিয়োগ প্রস্তাব। এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে ১৫৫ প্রতিষ্ঠান, ৫০০টি শিল্প স্থাপনের পূর্বাভাস ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে।
বেজার (বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি) সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চাকাক্সক্ষী উন্নয়ন উদ্যোগ। এটি দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগত সুবিধা জনক স্থানে অবস্থিত। যার পাশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। রেলপথ ব্যবহারের ও সুযোগ রয়েছে। দেশের বৃহত্তম চট্টগ্রাম নৌবন্দর ও পতেঙ্গা বিমানবন্দর এর ৬০/ ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।
ভবিষ্যতে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘেঁসেই নৌবন্দর ও বিমানবন্দর স্থাপনের সুযোগ ও পর্যাপ্ত জমি এখানে রয়েছে। বিগত স্বৈরাচারী সরকার এখানে নৌবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এখানে নৌবন্দর স্থাপন এখন সময়ের দাবি। সেই সাথে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘেঁসে অদূর ভবিষ্যতে এখানে একটি সেনানিবাস ও বিমান ঘাঁটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেনানিবাস স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা : বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ খ্যাত ফেনী করিডোরের নিরাপত্তার জন্য ফেনীতে সেনানিবাস স্থাপনের দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় হুমকি ও আগ্রাসন মোকাবেলায় যা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ফেনীর নিকটতম সেনানিবাস কুমিল্লা সেনানিবাস। যেখান থেকে ফেনী সীমান্তে পৌঁছতে লাগবে অন্তত এক ঘণ্টা। তাছাড়া এখানে নৌবন্দর স্থাপিত হলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করবে।
নতুন ১০ অর্থনৈতিক অঞ্চল: বিগত সরকার সারাদেশে ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যা বাস্তব ভিত্তিক ছিল না। মূলত তা ছিল লুটপাটের মেগা প্রকল্প। ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বিগত সরকার হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে রেখেছে। যা ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এর মধ্যে মাত্র দশটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য সরকার কাজ করবে। সেগুলি হচ্ছে, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চল, কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কুড়িগ্রাম ভুটানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
কর্মসংস্থানের বিশাল সুযোগ : সম্প্রতি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, নতুন যে সেটআপ সেটা অনুযায়ী আমাদের ফোকাস থাকবে ইনভেস্টরদের জন্য আমরা যা প্রমিস করব তা আমরা সময়মতো ডেলিভারি দেয়ার চেষ্টা করব। তিনি জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলটি পুরোদমে উৎপাদনে এলে এতে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ : বিগত সরকারের পরিকল্পনা দুর্বলতায় দীর্ঘ সময়েও জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নে গতি আসেনি। ভারতের তল্পিবাহক আওয়ামী সরকার এখানে ভারতকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ৯০০ একর জমি দিয়েছে যে জমি কেনা বেচা বা যে জমিতে দেশী-বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন বর্তমান সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ফেনী করিডরের মত নাজুক স্থানে ভারতের মতো বৈরী প্রতিবেশীকে ঘাঁটি গাড়তে দিবে কিনা। সমগ্র দেশবাসী যার বিরোধিতা করছে।
সড়ক ও নিরাপত্তা বেষ্টনী : সূত্রে জানা গেছে এখানে ১ কোটি ১৫৬ ঘনমিটার সড়ক, ৩৬ হাজার ৬৫ বর্গ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ করা হবে। মোট ৬১ হাজার ২৮০মিটার ড্রেন, ৯ হাজার ৩৮ মিটার কাঁটাতারের বেড়া এবং ৪৪৬৫ মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মিত হবে। এছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরির আবাসিক ভবন, ক্লাব, প্রশাসনিক ভবন কাস্টমস ভবন, সার্ভিস ভবন, থাকবে। কমপ্লেক্সে মসজিদ, হাসপাতাল সহ অন্যান্য সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। থাকবে খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র।
প্রবেশ দ্বারে হবে মহাজংশন : বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের প্রবেশ দ্বারে হবে দেশী-বিদেশি বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির এক মহা জংশন।এটি হবে সর্বাধুনিক শিল্প নগরী, এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনৈতিক ও শিল্প জোন।
শুরু এবং শেষ : জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে মূলত ভারতের চাপে। ভারতকে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য খুলনা ইপিজেডে আওয়ামী সরকার বিনামূল্যে ৫০০ একর জমি দিয়েছিল কিন্তু ভারত তাতে কোন আগ্রহ দেখায়নি। বরং ভারত বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে ফেনীতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে। তখন সরকার ভারতীয় চাপের কাছে নতি স্বিকার করে এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অর্থনৈতিক অঞ্চল নাম দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে কাজ শুরু করে। সরকার ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভারতকে ৯০০ একর জমি বিনামূল্যে দেয়। ফেনী করিডোর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ত্রিপুরা থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারতের সেভেন সিস্টারের সাথে যোগাযোগ করাই ছিল ভারতের মূল উদ্দেশ্য। এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ যদি ঠিকঠাক মতো চলে তাহলে প্রায় দুই দশক সময় লাগবে এটা পুরোপুরি নির্মাণ হতে।
বাংলাদেশের জন্য সাপেবর : বিগত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার অবৈধ শাসনামলে ফেনীতে তেমন কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি। হয়নি বহুল কাক্সিক্ষত ও দাবিকৃত ফেনীতে একটি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এর কারণ ছিল ফেনীর প্রতি শেখ হাসিনার চরম। বিদ্বেষভাব। ফেনী বেগম জিয়ার জেলা এটাই ছিল ফেনীর অপরাধ কিন্তু ভারতের সুবিধার্থে এবং ভারতের চাপে সে সময় ফেনীতে নেয়া হয় একটি মেগা পরিকল্পনা যা শুধু দেশের নয় এশিয়ার বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ। সেটাই বর্তমান জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ভারতের চাপে এই শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হলেও বর্তমানে দেশপ্রেমিক অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেসব হিসাব নিকাশ ওলট-পালট হয়ে গেছে। ফলে ভারতের দুর্বিসন্ধি কোন কাজে আসেনি।