নিজেই ধুঁকছে খুলনার সংক্রামন ব্যাধি হাসপাতালটি। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, অরক্ষিত সীমানা প্রাচীর ও সংরক্ষিত ওষুধে ধরেছে উইপোকা। ১৯৬৮ সালে খুলনার খানজাহান আলী থানার মীরেরডাঙ্গায় ভৈরব নদী সংলগ্ন ৪ একরের অধিক জায়গার উপর নির্মিত হয় ২০ শয্যাবিশিষ্ট সংক্রামণ ব্যাধি হাসপাতালটি। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কোটি মানুষের ডায়রিয়া, টিটেনাস, হাম, জলাতঙ্কসহ সংক্রামক রোগের চিকিৎসা সেবার একমাত্র বাতিঘর। প্রতিষ্ঠার পর কেটে গেছে ৫৬ বছর। বাড়েনি শয্যা সংখ্যাসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা। বদলায়নি হাসপাতালের চিত্র।

দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে আয়া, দু’জন বাবুর্চি, চারজন সহকারী নার্স, একজন মেডিকেল অফিসার, দু’জন ওয়াড বয়, নিরাপত্তা প্রহরী, নৈশপ্রহরী, ৩ জন পরিচ্ছন্ন কর্মীর পদশূন্য রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের ৬ জন কর্মী দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও ১৬ মাস এরা বেতন পাচ্ছেন না। নিয়মিত বেতন না পেয়ে একজন কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাকিরা বেতন না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বর্তমানে দু’জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে হাসপাতালটির চিকিৎসা কার্যক্রম। অস্থায়ীভাবে ডেপুটেশনে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন বাকি দু’জন চিকিৎসক। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কার্যালয় এটি অরক্ষিত। জানালার গ্রিল ভাঙ্গা। চিকিৎসকদের বিশ্রাম নেওয়ার রুমটিতে কোন ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই। রাতে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের গরম এবং নিরাপত্তাহীনতায় বিশ্রামের কক্ষটিতে সময় কাটাতে হয়।

সীমানা প্রাচীর না থাকায় হাসপাতালটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত। জরাজীর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। ভেতরে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা। ছাদ এবং দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। বৃষ্টি হলে ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। স্যাঁতস্যাঁতে স্টোর রুমে সংরক্ষিত ওষুধে উইপোকা ধরেছে। আবাসিক ভবনগুলোরও একই অবস্থা। বসবাসের অনুপযোগী। পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারী। অরক্ষিত হাসপাতালের কোন নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় ভিতরে অবাধে গরু-ছাগল এবং বহিরাগতদের বিচরণ। হাসপাতালের সীমানার ভেতর অসংখ্য ফলজ এবং বনজ বৃক্ষ থাকলেও বহিরাগতদের অবাধে প্রবেশের কারণে সেগুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভোগ করতে পারে না। রাতে কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং নার্সদের ভয় এবং আতঙ্কে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তব্যরত এক নার্স বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটিতে কোন ওয়ার্ড বয় নেই। রাতে জরুরি চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ঝুঁকি নিয়ে গেট খুলে দিতে হয়। নৈশ প্রহরী না থাকায় রাতে ভয় এবং আতঙ্কে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এছাড়া দিনে-রাতে সর্বদা বহিরাগতদের উৎপাত সহ্য করতে হয়।

হাসপাতালের পিছনের বিস্তৃত এলাকা জঙ্গলে পরিপূর্ণ। জনবল সংকট চরমে। ২৩ টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১০ জন। ১৩ টি পদ কয়েক দশক ধরে শূন্য রয়েছে। হাসপাতালটিতে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত পুরুষ, মহিলা এবং শিশুর রোগীদের জন্য নেই কোন পৃথক বেডের ব্যবস্থা। একই ওয়ার্ডে পুরুষ মহিলা এবং শিশুদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। রোগীদের ব্যবহারের টয়লেটগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. হিমেল ঘোষ বলেন, সংকট সমাধানে বিভিন্ন সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মৌখিক এবং লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। জরাজীর্ণ হাসপাতাল এবং আবাসিক ভবনগুলো মেরামতের জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে নিরাপত্তা এবং নৈশপ্রহরী না থাকায় বরাদ্দ পাওয়া অনেক প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সংরক্ষণের অভাবে আনা সম্ভব হচ্ছে না। নৈশপ্রহরী না থাকায় রাতে হাসপাতালে থেকে অনেক সময় জিনিসপত্র চুরি হয়। ভবনের স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থার কারণে সঠিকভাবে ওষুধ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রতিবছর রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে ৩৫/৪০ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। গরম বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ করে এপ্রিল মাস থেকে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন শয্যাসংখ্যা এবং স্যালাইন সংকটের কারণে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ ৫২২ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন বলে তিনি আরও জানান।