গণঅভ্যুত্থানের পর সুন্দরবনে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে ২০টি সংঘবদ্ধ ডাকাতদল। বনজীবীরা সুন্দরবনে মাছ বা কাঁকড়া সংগ্রহ করার জন্য বাড়ি থেকে সুন্দরবনে রওনা হওয়ার সময় অনুমতি নিতে হচ্ছে তাদের কাছ থেকে। বিকাশের মাধ্যমে বনদস্যু দলকে ও কিছু নামধারী বনদস্যুদের সহযোগী কিছু মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে টোকেন নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়ার অনুমতি নিচ্ছেন বনজীবীরা। অনুমতি না নিলে জেলে, বাওয়ালি, মাওয়ালিসহ বনজীবীদের জিম্মি করে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায় করছেন বনদস্যুরা।

জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এতে আতঙ্কে রয়েছেন তারা।

সর্বশেষ সুন্দরবনের কুখ্যাত ডাকাত জাহাঙ্গীর বাহিনী সুন্দরবনের শিবসা নদীর ছোট ডাগরা খাল এলাকায় ৮ জন জেলেকে জিম্মি করে রাখে। কোস্ট গার্ড স্টেশন কয়রা কর্তৃক উক্ত এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে দস্যু দলের আস্তানা থেকে ১টি একনলা বন্দুক, ৪ রাউন্ড তাজা কার্তুজ এবং ৭ রাউন্ড ফাঁকা কার্তুজসহ জিম্মি থাকা জেলেদের উদ্ধার করে। তবে কাউকে আটক করতে পারেনি তারা।

উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানান, ৭ দিন আগে তাদের জিম্মি করে মাথা পিছু ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তাদেরকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন ৪ নম্বর কয়রার দেসার আলীর ছেলে আতিয়ার (২৮), একই গ্রামের আবু সাঈদ গাজির ছেলে আবুল খায়ের গাজি (২৪), মৃত মাদার আলীর ছেলে মকছেদ আলী (৫০), গনি হাওলাদারের ছেলে মিজানুর রহমান (৩৭), যাবদ রপ্তানের ছেলে কৃষ্ণপদ রপ্তান (৪৫), অগর মন্ডলের ছেলে সুগদেব মন্ডল (২৭), মহারাজপুর গ্রামের মৃত মালেক ঢালীর পুত্র মোশারফ হোসেন ঢালী (৬০), একই গ্রামের মৃত সবেদ আলী গাজির ছেলে লিল গাজি (৩৫)।

উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানান, ডন বাহিনী পরিচয়ে গত ৭ ডিসেম্বর সকালে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ মালঞ্চ নদীর হাঁসখালী, চেলাকাটা, হেতালবুনি খাল থেকে ৭ জেলেকে অপহরণ করে।

ফিরে আসা দুই জেলে ফজের আলী ও সবুজ মিয়া জানান, অপহৃত জেলেদের বাড়িতে খবর দেওয়ার জন্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের দাবি, সমিতি ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করে তারা বনে গিয়েছিলেন। এখন মুক্তিপণ দিয়ে সহকর্মীদের ছাড়াতে হবে। পরে তারা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান।

এছাড়া গত ৭ ডিসেম্বর রাতে কয়রা নদীর নাগজোড়া খাল সংলগ্ন এলাকা থেকে ১টি একনলা বন্দুক, ১ রাউন্ড তাজা কার্তুজ ও ১ রাউন্ড ফাঁকা কার্তুজসহ দোলাভাই বাহিনীর কবল থেকে ৪ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।

৪ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। এ সময় রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয় দুইপক্ষের মধ্যে। বনদস্যুদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনটি নৌকা, সোলার প্যানেল ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে বন বিভাগ।

২৯ নভেম্বর খুলনা রেঞ্জের কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে যান উপজেলার তেঁতুলতলা গ্রামের মইনুল ইসলাম (২৫)। ৩ ডিসেম্বর তার বাবা আব্দুর রউফ গাজীর মোবাইল ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি নিজেকে বনদস্যু আলামিন বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে মইনুলকে জিম্মি করার কথা জানায়। তাকে ছাড়াতে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়।

আব্দুর রউফ গাজি বলেন, ‘আমার ছেলেকে ডাকাতের কাছ থেকে ছাড়াতি টাকা জোগাড় করতি গিয়ে জানতি পারলাম, তাকে কোর্টে চালান করা হয়েছে। কিছুই বুঝতি পারতিছিনে।’

সুন্দরবন ঘেঁষা গ্রামগুলোর বাসিন্দারা জানান, সুন্দরবন জুড়েই এখন বনদস্যু আতঙ্ক। জেলেদের কেউ কেউ ভয় উপেক্ষা করে বনে ঢুকলেও অনেকেই আটক হয়ে বনদস্যুদের নৌকা চালাতে বাধ্য হন। কেউ কেউ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান। টাকা দিতে না পারায় নিরীহ অনেক জেলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি তাদের হরিণের গোশতসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়। এই কাজে দস্যুদের সহায়তা করছেন লোকালয়ে অবস্থানকারী সহযোগীরা।

সাম্প্রতিক বনদস্যুদের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া কয়েক জনের সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, সুন্দরবনে যাওয়ার আগে তাদের কাছে বনদস্যুদের হয়ে কিছু কোম্পানি নামধারী মাছ ব্যবসায়ী ও বনদস্যুদের সহযোগীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টোকেন নিতে। টোকেন ছাড়া সুন্দরবনে গেলে বনদস্যুদের কবলে পড়তে হবে বলে জানান তারা। তারা তাদের কথা না মেনে বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া ধরতে যান। বনদস্যুরা তাদের জিম্মি করে। তাদের মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়ে।

তারা জানান, বনদস্যু বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোর বাসিন্দা। এলাকার মহাজন নামধারী মাছ ব্যবসায়ীরা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাদের খাবার, অস্ত্র-গোলাবারুদ সবই সরবরাহ হয় এসব মহাজনের মাধ্যমে। জেলেদের অভিযোগ, বনদস্যুদের কাছে জিম্মি হওয়ার পর ছাড়া পেতেও এসব মহাজনের মধ্যস্থতা লাগে।

একাধিক জেলেসহ স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সুন্দরবনে এখন সক্রিয় আছে ২০টির মতো বনদস্যু বাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে আলামিন বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, মানজুর বাহিনী, দাদাভাই বাহিনী, করিম-শরীফ বাহিনী, আসাবুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনারুল বাহিনী, ডন বাহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনী। প্রতিটি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ৪০ জন। তাদের অনেকের হাতেই আছে আগ্নেয়াস্ত্র। সব চেয়ে বড় ও বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে জাহাঙ্গির বাহিনী। তাদের সদস্য সংখ্যা ৫০ এর অধিক। সকলের কাছে আছে আগ্নেয়াস্ত্র। বনের গহীনে আস্তানা থাকা এসব দস্যুর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলা নিরাপদ নয় বলে জানান জেলেরা। তাদের অভিযোগ, মাছের আড়ত ও সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামেও দস্যুদের সহযোগীরা সক্রিয়। কারও বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁস হলে পরে বনে ধরা পড়লে নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়ে।

বিভিন্ন সূত্রে এক বছরে সুন্দরবনের, কয়রা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, দাকোপ, নলিয়ানসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তিন শতাধিক জেলে অপহরণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। নৌকাপ্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা ও অপহৃত প্রতি জেলেকে মুক্ত করতে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হচ্ছে। এই টাকা বিকাশ ও বনদস্যুদের সহযোগীদের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে।

মোতালেব হোসেন নামে মহেশ্বরীপুর এলাকার এক জেলে বলেন, ‘অনেক দিন পর সুন্দরবনে আবার ডাকাত নেমেছে। নদীতে মাছ তেমন হয় না। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ডাকাতির টাকা দেবো নাকি ঋণ শোধ করব! বড় চিন্তায় আছি।’

ওই এলাকার জেলেরা জানান, সুন্দরবনে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল জেলেদের কাছে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। তারা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

একাধিক বন কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন সুন্দরবনে বনদস্যুমুক্ত থাকার পর অতিসম্প্রতি আবারও বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বনদস্যুদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও দ্রুতগামির জলযান। কিন্তু আমাদের কাছে ভারি অস্ত্র ও নাই, না আছে দ্রুত গতির নৌযান। তাই আমরা অনেকটাই নিরূপায়। এই বাহিনীর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে ভারতে বসে বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে জেলেদের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করছে বলে জেলে-বাওয়ালিরা অভিযোগ করেছেন।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য, ৪৬২টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। ফলে সম্পূর্ণরূপে জলদস্যুমুক্ত হয় সুন্দরবন। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন।

র‌্যাব-৬ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৭০টির বেশি সফল অভিযান পরিচালনা করে ৯১১ জন বনদস্যুকে তারা গ্রেফতারপূর্বক ২০২৮টি অস্ত্র ও ৪২,৬৯০ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে এই বাহিনীর নিস্ক্রিয়তার কারণে আবারও সুন্দরবনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যু বাহিনীগুলো। তবে বর্তমানে র‌্যাবের সাথে যোগাযোগ করা হলে এই বিষয়ে কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘দস্যু দলগুলো এতটাই প্রভাবশালী যে বন বিভাগের একার পক্ষে তাদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কয়েক বার জানানো হয়েছে। বনদস্যু নির্মূলে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় অভিযান অব্যাহত আছে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন বাহিনীর সাথে উপদেষ্টারা একটি সমন্বয় সভা করেছেন। সেখানে কোস্টগার্ডকে সুন্দরবনের দস্যু নির্মূলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। শিগগিরই যৌথ অভিযান চালানো হবে।’

কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার (অপারেশন) লে. কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনে জলদস্যুদের উৎপাত শুরু হলে কোস্টগার্ড সুন্দরবনে মোট ৩২টি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ৪২টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৯টি বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি, ১৮৭ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৯৬ রাউন্ড ফাঁকা কার্তুজ, ২টি ককটেল এবং ৪৭৯টি স্প্রিন্টার বল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও মোট ৪৯ জন জলদস্যু ও তাদের সহযোগীরা আটক করা হয়েছে এবং জলদস্যুদের নিকট জিম্মি থাকা ৫৬ জন জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কোস্টগার্ডের এ সব অভিযানের ফলে দস্যু বাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। দস্যু বাহিনী নির্মূলে কোস্টগার্ড নিয়মিত অপারেশন, হটস্পট এলাকায় বিশেষ টহল এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ডাকাতদলের আত্মসমর্পণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো দস্যু দল আত্মসমর্পণ করতে চায়, তাহলে আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করে তাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেব। বর্তমানে কোস্টগার্ড এ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার জন্য বিশেষ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’