গাজীপুরের বিস্তীর্ণ বর্ষার বিলগুলো এক সময় ছিল প্রাণবন্ত জলজ জীববৈচিত্র্যের আধার। এখন সেই বিলগুলো এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ও চক্রের দখলে চলে যাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে গঠিত এসব জলাভূমি এখন মাছ চাষের নামে বাঁধ, জাল ও কৃত্রিম ঘেরের আওতায় পড়ে গেছে। এতে দেশীয় মাছের প্রবাহ যেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তেমনি কৃষি জমিও হয়ে পড়ছে জলাবদ্ধতার কবলে। ফলে বিলভিত্তিক জীবনধারা, জীবিকা ও পরিবেশ আজ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে।
গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কুমুন-চিলনী-রোসাদিয়া এলাকার ঐতিহাসিক বেলায় বিলের একটি বড় অংশে প্রভাবশালী স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান এস. এম. হাবিবুর রহমান খান কর্তৃক নির্মিত বাঁধের ফলে প্রায় ১২শথ বিঘা জমি মাছ চাষের আওতায় চলে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগী কৃষক নুরু খান জানান, বাঁধ নির্মাণের কারণে বর্ষার স্বাভাবিক পানি আসছে না, দেশীয় প্রজাতির মাছ আসছে না এবং জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় কৃষকরা সময়মতো চাষাবাদ করতে পারছে না। এতে করে প্রায় ৩০০টি পরিবার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে প্রভাব খাটিয়ে চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান খানের ছোট ভাই রতন খান সাবেক ইউএনও'কে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে এমপি মেহের আফরোজ চুমকির সহযোগিতায় রোসাদিয়া-চিলনী এলাকায় জোরপূর্বক বাঁধ নির্মাণ করেন এবং প্রতিবাদকারী সাধারণ মানুষদের মারধর করে দমন করা হয়।
স্থানীয় রতিন মজুমদার, যতিন মজুমদার, সুরেন্দ্র দাসসহ এলাকাবাসী এই বেআইনি বাঁধ অপসারণের দাবিতে গাজীপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
শুধু বাড়িয়া ইউনিয়ন নয়, গাজীপুর মহানগরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বালু চাকুলী, বাঙ্গালগাছ, জয়দেবপুর, কানাইয়া সহ আরও অনেক এলাকার বর্ষাকালীন প্রাকৃতিক বিলও এখন দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী কিছু চক্র বর্ষার স্বাভাবিক পানিতে ঘের দিয়ে মাছ চাষ করছে, ফলে দেশীয় মাছ ও কৃষকরা উভয়েই ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
গাজীপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ হাসিবুল হাসান বলেন, “বাড়িয়া ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বেলায় বিলে রোসাদিয়া এলাকায় বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি ২০১৮ সাল থেকেই চলমান। দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অনিয়মকে বরদাস্ত করা হবে না।
গাজীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, “শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জে দূষণে আমাদের নদী-নালা, খাল-বিলের দেশীয় মাছের প্রজাতি ধ্বংসের মুখে। বর্ষাকালে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে দেশীয় মাছ প্রবেশ করতো, কিন্তু এখন মাছ চাষের জন্য জাল ও বাঁধ বসিয়ে এই প্রবাহ ব্যাহত করা হচ্ছে। এটি প্রাকৃতিক মাছের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ হুমকি। আমরা কোনো প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ বা মাছের গতিপথ রুদ্ধ হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি এবং অভিযোগ পেলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
গাজীপুর সদর এসিল্যান্ড মোঃ মঈন খান এলিস বলেন, “আমরা গাজীপুরের ঐতিহাসিক বেলায় বিল সংরক্ষণের জন্য কাজ করছি। কেউ যাতে প্রাকৃতিক জলাশয়ে স্থাপনা নির্মাণ বা দখল-দূষণ করতে না পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
স্থানীয় পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন, এক সময় বিলগুলোতে শুধু মাছই ছিল না, ছিল নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, পাখি, ব্যাঙ ও কাঁকড়া। বর্ষা এলেই শিশুদের মাছ ধরা, কিশোরদের দাপাদাপি, প্রৌঢ়দের মাছ শিকার ছিল একটি বর্ণিল সামাজিক সংস্কৃতি। আজ সেই সব দৃশ্য কেবল স্মৃতির পাতায়।
গাজীপুরের বর্ষার বিল শুধু জলাভূমি নয়, এটি কৃষি, পরিবেশ ও ঐতিহ্যের ধারক। অথচ সেসব এখন পুঁজিবাদী ও প্রভাবশালীদের দখলে। এখনই যদি প্রশাসন, পরিবেশ রক্ষাকারী সংস্থা এবং সচেতন নাগরিকরা একত্র হয়ে প্রতিরোধ না গড়ে তোলে, তাহলে অচিরেই গাজীপুর তার প্রাকৃতিক পরিচয় হারাবে। প্রকৃতি বাঁচলে তবেই বাঁচবে দেশীয় মাছ, কৃষক, জেলে এবং বিলকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবন।