রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক ঘটনায় দগ্ধ হয়ে আইসিইউতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে ৩ জন। এদের মধ্যে ১ জন রয়েছে লাইফ সাপোর্টে। গতকাল সোমবার বিকেল ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন।

তিনি বলেন, এখনো ৩৩ জন রোগী এখানে ভর্তি রয়েছে। যাদের মধ্যে ২৭ জনই শিশু। এদের মধ্যে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে ৩ জন। যাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এদের চাইতে একটু কম গুরুতর অর্থাৎ সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে রয়েছে ৯ জন। বাকিরা অন্যান্য ওয়ার্ড ভর্তি রয়েছে। অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, আজ আরও ৩ জনকে ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে আবহাওয়া খারাপ থাকায় এবং তাদের আরেকটি ড্রেসিং দরকার মনে করায় আজকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। চলতি সপ্তাহে আরও বেশ কয়েকজনকে পর্যায়ক্রমে ছাড়পত্র দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক। এছাড়া বিমান বিধ্বস্তে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারত থেকে আসা চিকিৎসকরা পর্যায়ক্রমে স্ব স্ব দেশে চলে গেছেন এবং বাকিরা চলে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

জানা যায়, উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে ৪৫ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তার মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩৩ জন, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১১ জন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১ জন রয়েছেন। অন্যদিকে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৮ জন, ঢাকা সিএমএইচে ১৪ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জন, ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ছুটি বাড়ল শনিবার পর্যন্ত : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আরও তিন দিন ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ফলে গতকাল সোমবার থেকে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তৃতীয় দফায় ছুটি বাড়িয়ে আগামী শনিবার পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মো. মাসুদ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের দিয়াবাড়ি স্থায়ী ক্যাম্পাস শনিবার (২ আগস্ট) পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। তবে সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে। মো. মাসুদ আলম বলেন, আমরা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছি, তারা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরতে আগ্রহী। আশা করছি, দ্রুতই আমরা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরতে পারব। ২১ জুলাই দুপুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপর প্রথম দফায় ৩ দিন এবং পরে শুক্র ও শনিবার মিলিয়ে সোমবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয় দ্বিতীয় ধাপে। সর্বশেষ আজ তৃতীয় দফায় ছুটি বাড়ানো হলো।

বিমানবাহিনীর চিকিৎসা ক্যাম্প: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এই ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ নিচ্ছেন অনেকে। তাদের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের আত্মীয়স্বজন। বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অস্থায়ী এই চিকিৎসা ক্যাম্প সোমবার শুরু হয়েছে। চলবে এক সপ্তাহ। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এখান থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রবেশমুখে অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পের সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। নামনিবন্ধন করে ১০৮ নম্বর কক্ষের সামনে অপেক্ষায় থাকা মাইলস্টোন স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহমেদ আল ফাতাহ জানায়, যে ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, সেটির দোতলায় ছিল তার শ্রেণিকক্ষ। স্কুল ছুটি হওয়ায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের কয়েক মিনিট আগে সে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে ক্যানটিনে চলে গিয়েছিল। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বন্ধু শামীমকে হারিয়েছে সে। নানার সঙ্গে বিদ্যালয়ে আসা এই শিক্ষার্থী জানায়, রাতে ঘুমানোর সময় ভয় পাই। দুঃস্বপ্ন দেখি। বন্ধু শামীমকে স্বপ্নে দেখি। চিকিৎসা ক্যাম্পে সেবা দিচ্ছেন বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার চিকিৎসক শিহাব আলী। তিনি বলেন, মাইলস্টোনের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ঘটনার দিন উপস্থিত ছিল, তাদের অনেকেই আসছেন। ঘটনার পর থেকে রাতে ঘুম হচ্ছে না-এমন লোকজন আসছেন। আগুনে সামান্য দগ্ধ হওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী এসেছে। অনেকে ড্রেসিং করাচ্ছেন, অনেকে ওষুধ নিচ্ছেন। এ ছাড়া যাদের অনেক বেশি মানসিক সমস্যা পাওয়া যাবে, তাদের সিএমএইচে পাঠানো হবে। তবে এ পর্যন্ত কাউকে পাঠানো হয়নি।

চিকিৎসা ক্যাম্পে বিমানবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, আজকে দুজন চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন। সঙ্গে আছেন চিকিৎসা সহকারীরা। মোট ১৫ সদস্যের একটি দল এই ক্যাম্প পরিচালনা করছেন। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চিকিৎসা ক্যাম্পের বিষয়টি জানানো হয়েছে। সামান্য পুড়ে যাওয়া কিংবা আগুনের আঁচ লাগা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি ড্রেসিং করানো, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছু আহত ব্যক্তি, যাঁরা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, কিন্তু এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন, তাঁরাও চিকিৎসক দেখাতে এসেছেন।

ভোলায় মাসুমার কবর জিয়ারত বিমানবাহিনীর: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিহত কর্মচারী মাসুমা বেগমের কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিমানবাহিনী। গতকাল সোমবার দুপুরে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের উত্তর বাটামারা গ্রামে যায় বিমানবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্বে ছিলেন বরিশাল বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার এ বি এম সারোয়ার জাহান। সেখানে পৌঁছানোর পর মাসুমার পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেয় দলটি। পরে বাহিনীটির প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনের পক্ষ থেকে মাসুমার কবরে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ ছাড়া তার কবর জিয়ারত করে আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কর্মসূচিতে আরও উপস্থিত ছিলেন নিহত মাসুমার স্বামী সেলিম, ছেলে মানসুর, বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিদ্দিকুর রহমান ও স্থানীয় বাসিন্দারা। সারোয়ার জাহান বলেন, মাসুমার পরিবারকে যত রকমের সহযোগিতা দরকার, আমরা তা করব। আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট পজিটিভ। ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। মাসুমা বেগম ওই স্কুলের কর্মচারী (আয়া) হিসেবে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে দগ্ধ হন। তার শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। গত শনিবার সকালে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।