ভারতে ইলিশ রফতানি, রফতানিকারকদের মজুদ ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার বাজারগুলোতে ইলিশ মাছের দেখা মিলছে না । এই ভরা মওসুমে অল্প কিছু মাছ আসছে, তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ সালে ৫.৫০ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়, ২০২০-২১ সালে উৎপাদন হয় ৫.৬৫ লাখ টন, ২০২১-২২ সালে ৫.৬৭ লাখ টন, ২০২২-২৩ বেড়ে দাড়ায় ৫.৭১ লাখ টনে (সর্বোচ্চ)। কিন্তু গত ২০২৩-২৪ সালে ৪২ হাজার টন উৎপাদন কমে দাড়ায় ৫.২৯ লাখ টনে । এটি গত পাচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু সংখ্যা নয়, বড় ইলিশও কমে গেছে, বাজারে বেশি আসছে ছোট জাটকা।

চলতি মওসুমে ভারতীয় বাজারে ইলিশ রফতানির অনুমোদন মেলে প্রায় ১,২০০ টন। ভারতীয় বাজারে রফতানির কারণে স্থানীয় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কমেছে। প্রান্তিক জেলেদের উৎপাদিত মাছের বড় অংশ রফতানির জন্য সরাসরি চলে গেছে। ফলে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বাজারে মাছের অভাব তৈরি হয়েছে। আড়ৎদাররা কম সরবরাহের কারণে দাম বৃদ্ধি করেছেন, কারণ সাপ্লাই কমলে মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। সরবরাহ কমার সঙ্গে সঙ্গে দাম চড়া হয়েছে।

৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ইলিশের দাম কেজি ১,৩০০ থেকে ১,৪০০ টাকা পর্যন্ত, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বড় ওজনের মাছের দাম বেড়ে গিয়ে ২ কেজি ইলিশের জন্য ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ইলিশ এখন নাগালের বাইরে, যা সামাজিক অসন্তোষ এবং ক্রেতাদের হতাশা সৃষ্টি করেছে। বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ায় দোকানগুলোতে ইলিশ মাছ রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দাম বাড়লেও ক্রেতা না থাকায় কিছু দোকান মাল বিক্রি করতে পারছে না, ফলে লোকসান হচ্ছে। আড়ৎদারদেরও লাভের মার্জিন কমেছে, কারণ কম সরবরাহ ও বাজারের অনিশ্চয়তার কারণে ক্রয়-বিক্রয় চক্র ব্যাহত হচ্ছে। কিছু প্রান্তিক জেলে রফতানির জন্য মাছ সরবরাহে অংশগ্রহণ করছেন। স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ কমে যাওয়ায় ছোট জেলেদের আয় হ্রাস পাচ্ছে। জেলেরা বড় বাজার ও পাইকারি চেইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, যা তাদের স্বতন্ত্র বিক্রির সুযোগ কমাচ্ছে। রফতানির ফলে বড় আড়তে মাছ মজুদ হচ্ছে। স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরা ছোট পরিমাণে মাছ কিনতে পারছেন না। বাজারে হাতবদল বেড়ে যাওয়ায় দাম স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে ইলিশ রফতানি খুলনা ও দেশের বাজারে সরবরাহ কমানো, দাম বৃদ্ধি, খুচরা ব্যবসায়ীদের ক্ষতি, জেলেদের আয় হ্রাস এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া সব মিলিয়ে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

রপসা পাইকারি আড়তে মংলা থেকে আসা এক জেলে আসাদ মোড়ল জানালেন, এবার বিরূপ আবহাওয়ার কারণে জেলেরা আশানুরূপ ইলিশ ধরতে পারেনি। আড়ৎদার মোজাফফর হোসেন আশেক বলেন, আগে এক জালে ৫০থেকে ১০০ মণ ইলিশ পাওয়া যেত। এখন ৫ থেকে ৭ মণ পেতেও কষ্ট হয়।

নিউমার্কেট বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আফজাল শেখ বলেন, এখনকার দামে দোকানে মাছ তোলা ভীষণ কঠিন। সারাদিন বসেও কয়েকটা মাছ বিক্রি হয়।

খালিশপুর বাজারের ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান বলেন, অনেক সময় ইলিশ কয়েক দিন পড়ে থাকে, তখন বাধ্য হয়ে কেনা দামে বা তারও কমে বিক্রি করতে হয়। ইলিশ শুধু একটি মাছ নয় এটি বাঙালির সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু সরবরাহ ঘাটতি, রফতানি নীতি, আবহাওয়া প্রতিকূলতা ও বাজারের নিয়ন্ত্রণহীনতায় বাংলাদেশে ইলিশ ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে ইলিশ একসময় উৎসবের প্রতীক ছিল, তা এখন সাধারণ মানুষের জন্য কেবল গল্প কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিতেই সীমাবদ্ধ। মাছের রাজা বাঁচাতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী, জেলে ও ভোক্তা সবাইকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।