গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : বাংলার গ্রামাঞ্চলে সুপারি গাছ শুধু একটি ফলজ গাছ নয়, এটি গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অনন্য প্রতীক। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গ্রামীণ প্রান্তরে এই সুপারি গাছের সারি যেন এক নিঃশব্দ সৌন্দর্যের চাদরে মুড়ে রাখে পুরো অঞ্চলকে। পল্লির বাড়িঘর, উঠান, কিংবা গ্রামের রাস্তার ধারেÑযেখানেই তাকানো যায়, দেখা মেলে সুপারি গাছের মাথা উঁচু সবুজ সারি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সুপারি চাষের ইতিহাস বেশ পুরনো। স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হয়, কয়েক শত বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম অঞ্চল থেকে এ গাছের চারা এনে রোপণ করা হয়। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পলিমাটিতে সুপারি গাছের বৃদ্ধি দ্রুত হওয়ায় এখানকার কৃষকেরা সহজেই এটি গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে বাড়ির আঙিনা ছাড়িয়ে এখন বাণিজ্যিকভাবেও চাষ হচ্ছে অনেক গ্রামে।
সুপারি গাছ সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ভালো জন্মে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়া—গরম ও শুষ্ক মৌসুমের সঙ্গে মাঝে মাঝে মাঝারি বৃষ্টিপাত—এই গাছের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। জেলার শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর, নাচোল ও ভোলাহাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন সুপারি গাছের চাষ বাড়ছে দ্রুত। বিশেষ করে পদ্মা ও মহানন্দা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে এর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য।
একসময় সুপারি ছিল শুধুমাত্র গৃহস্থালির প্রয়োজন মেটানোর গাছ। কিন্তু বর্তমানে এটি অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর সুপারি বিক্রি করে অনেক কৃষক বাড়তি আয় করছেন। বাজারে শুকনা সুপারির দাম কেজিপ্রতি ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। ফলে অল্প জায়গায় বেশি লাভ হওয়ায় অনেকে এখন ধান বা পাটের বদলে সুপারি বাগান গড়ে তুলছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় প্রায় ৫৫০ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
সুপারি গাছের প্রতিটি অংশের ব্যবহার রয়েছে। ফল খাওয়া ছাড়াও এর শুকনা খোল পানের সঙ্গে খাওয়া হয়। আবার এর কান্ড ও পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের বেড়া, ছাউনি কিংবা বিভিন্ন হস্তশিল্প পণ্য।
গ্রামীণ সমাজে অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপকরণ হিসেবে পান-সুপারি আজও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
এই গাছ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখছে। সুপারি গাছের পাতা বাতাসে আর্দ্রতা ধরে রাখে, ছায়া দেয়, এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে। এছাড়া এটি গ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে—যেন সবুজের এক প্রাকৃতিক প্রাচীর।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত জাতের চারা, রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা, এবং সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা গেলে এই শিল্প আরও প্রসারিত হতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সুপারি চাষিদের আধুনিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সঠিক পরিচর্যা করলে এটি অত্যন্ত লাভজনক ফসল হতে পারে।”