কৃষকের উৎপাদিত ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ, মূল্য কমিশন গঠনসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছে খানি বাংলাদেশ। এছাড়া ধান ও চালের মতো অন্যান্য ফসল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ, কৃষিজোনভিত্তিক কমিউনিটি সংরক্ষণাগার এবং হিমাগার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়। প্রান্তিক কৃষকদের দীর্ঘদিনের মূল্য বঞ্চনার চিত্র এবং সম্প্রতি মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষি সাইফুল শেখের আত্মহত্যার ঘটনায় সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে চিত্র তুলে ধরা হয় এ সাংবাদিক সম্মেলনে।
গত ২৬ মার্চ পেঁয়াজ চাষে লোকসান এবং ঋণ পরিশোধ করতে না পারার চাপে মেহেরপুর মুজিবনগরের পেঁয়াজচাষি সাইফুল শেখ নিজ জমিতে বিষপান করেন এবং ২৮ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ এপ্রিল খানি বাংলাদেশ সদস্য, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, কৃষি গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের এক তথ্যানুসন্ধান দল ভুক্তভোগী পরিবার, স্থানীয় কৃষক এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করেন। এই পরিদর্শন, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং ভুক্তভোগীর পরিবার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরসহ অন্যান্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে আসা প্রান্তিক কৃষকদের অসহনীয় বাস্তবতার চিত্র এই সাংবাদিক সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।
সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তারা কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার দীর্ঘদিনের চিত্র তুলে ধরেন। এর পেছনের কারণ হিসেবে ফড়িয়াবাজি, সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, দুর্বল বিপণন ব্যবস্থা, নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের অভাব এবং এক্ষেত্রে সরকারি উদাসীনতাকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। আলোচনায় ধান ও চাল ছাড়া অন্যান্য কৃষিপণ্য সরকারিভাবে সংগ্রহ না করা এবং খাদ্যশস্য সংগ্রহে বিদ্যমান অস্বচ্ছ পদ্ধতির কারণে কৃষকদের নিয়মিত প্রতারিত হওয়ার বিষয় বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আত্মহত্যার শিকার কৃষক সাইফুল শেখের মেয়ে রোজেফা খাতুন ও মা রমেসা বেগম। এছাড়াও খানির তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিনিধিসহ অন্যদের মধ্য উপস্থিত ছিলেন খানির সহ-সভাপতি রেজাউল করিম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাহিদা সুলতানা, ইনসিডিন বাংলাদেশের মুশফিক সাব্বির, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজার অমিত রঞ্জন দে, সাংবাদিক সাইফুল মাসুম, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক- প্রানের নির্বাহী প্রধান নুরুল আলম মাসুদ প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন খানির সভাপতি ও কৃষিবিজ্ঞানী ড. জয়নুল আবেদীন।
ড. মোশাহিদা সুলতানা বলেন, সম্প্রতি সরকার যে সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে কৃষির বিষয় উঠে আসেনি। এমনকি এবার ধানের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার যে পরিমাণ ধান কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাও কেনেনি। কৃষকদের বঞ্চনা থেকে রক্ষা করতে আমাদের কোন কোন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন তা চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সংস্কারের আওতায় আনতে হবে
পেঁয়াজচাষি সাইফুল শেখের মেয়ে রোজেফা খাতুন তার বাবার আত্মহত্যার কারণ হিসেবে চাষাবাদে আর্থিক ক্ষতির ফলে সৃষ্ট গভীর হতাশা ও মানসিক দুশ্চিন্তার কথা উল্লেখ করেন। এ ঘটনার পর তাদের পরিবারের চরম দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
রোজেফা খাতুন বলেন, আমার বাবা বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থা ও সারের দোকান থেকে ঋণ নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন। দুই বিঘা জমিতে চাষ করতে যেখানে আমার বাবার দেড় লাখ টাকা খরচ হয়, সেখানে তিনি বিক্রি করে পেয়েছিলেন মাত্র ৫৮ হাজার টাকা। আমার বাবা প্রতিমণ পেঁয়াজ বিক্রি করেন ৬০০ টাকায়, অথচ এখন বাজারে পেঁয়াজের মণ ২ হাজার টাকা। সরকারের কাছে অনুরোধ শ্রমিকের অধিকার, কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করবেন। যেন আর কেউ তার বাবা না হারায়।
খানি সভাপতি কৃষিবিজ্ঞানী ড. জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের দরকার এমন সংস্কার যেখানে উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়ই লাভবান হয়। এই সংস্কারের জন্য আমাদের দরকার একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টা। তবে নেতৃত্বটা সরকারকেই দিতে হবে। আমরা হয়তো একটা কেস নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আরও কত ঘটনা আছে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, ফসল যখন কৃষকের ঘরে থাকে তখন এর দাম থাকে না। কিন্তু ফসল যখনই মহাজনের হাতে যায় তখনই দাম বেড়ে যায়। কৃষক যখন পেশা পরিবর্তন করে ভ্যান চালানো শুরু করে, তা কি আত্মহত্যা নয়?
বাংলাদেশে কৃষিঋণের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে মসলা চাষে কৃষি ঋণে সুদের হার ৪ শতাংশ। কিন্তু কৃষকেরা জটিলতার ভয়ে ঋণদাতা সংস্থা থেকে এর চেয়েও বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছেন। আর এনজিওগুলোও মৌসুমি ঋণ না দিয়ে নিয়মিত ঋণ দেয়। এতে করে কৃষকেরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন।