গাজীপুরের টঙ্গী টিএনটি বাজার জামে মসজিদের খতিব আলহাজ ক্বারি মুফতি মহিবুল্লাহ মিয়াজীকে অপহরণের এক দিন পর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় শিকল বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে তেঁতুলিয়া থানার হেলিপ্যাড বাজার এলাকায় স্থানীয়রা তাকে দেখতে পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিলে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার করে এবং পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন।
পঞ্চগড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জ্ঞান ফিরলে মুফতি মহিবুল্লাহ জানান, বুধবার (২২ অক্টোবর) সকাল সাতার দিকে টঙ্গী ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা দিয়ে হাঁটার সময় একটি অ্যাম্বুলেন্স তার পথরোধ করে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামা পাঁচজন লোক তাকে চেতনা নাশক দিয়ে জোরপূর্বক তুলে নেয়। সারাদিন তাকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হয় এবং ভোররাতে পঞ্চগড়ের এক নির্জন এলাকায় এনে পায়ে শিকল বেঁধে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে রেখে যায়। যাওয়ার আগে অপহরণকারীরা তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার হুমকিও দেয়।
তিনি আরও জানান, গত চার মাস ধরে ইসকনের নামে একাধিক উড়োচিঠি পাঠিয়ে তাকে বিভিন্ন ধর্মবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। চিঠিগুলোতে ইস্কন নেতা চিন্ময় দাসের মুক্তি, অখ- ভারতের সমর্থন এবং ধর্মীয় বিবাহ-বিষয়ক বিতর্কিত বক্তব্য প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব নির্দেশ অমান্য করায় তাকে হত্যার হুমকি এবং সর্বশেষ অপহরণের শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঘটনার পর টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত মাঠে নামে। বুধবার সন্ধ্যা থেকে পুরো এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে।
এ বিষয়ে টঙ্গী পূর্ব থানার অফিসার ইনচার্জ অহিদুজ্জামান বলেন, তেঁতুলিয়া থানার পুলিশ ৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর পেয়ে মুফতি মহিবুল্লাহ মিয়াজীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।
গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদ হাসান বলেন, আমরা ঘটনার পর থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কারও উসকানিতে যেন কেউ বিভ্রান্ত না হয় আমি সে আহ্বান জানাচ্ছি। ইসলামী দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি, সভা আহ্বানের মাধ্যমে তাদের পরামর্শ নিচ্ছি এবং সবাই মিলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, প্রশাসন জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
গাজীপুর-৬ আসনে জামায়াত মনোনীত এমপি পদপ্রার্থী ড. হাফিজুর রহমান এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, টঙ্গীর টিএনটি মসজিদের খতিব মাওলানা মুহিবুল্লাহ মাদানী হুজুর গতকাল নিখোঁজ হয়েছিলেন; আজ কিছুক্ষণ আগে তাকে পঞ্চগড় থেকে শিকলবাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। উনার বড় ছেলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তারা এখন পঞ্চগড় আছেন। রাব্বুল আলামিন রহম করুন, হুজুরকে সুস্থভাবে আবার মিম্বারে ফিরিয়ে দিন।
তিনি আরও বলেন, যতটুকু জেনেছি, তাকে বেশ কয়েকদিন ধরে চিঠির মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই। নতুন বাংলাদেশে কেউ যেন গুম কিংবা কোনো ধরনের জুলুমের শিকার না হয় সেজন্য রাষ্ট্রকে শক্তভাবে কাজ করতে হবে। ইমাম ও খতিবদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে চলতে পারে না।
প্রসঙ্গত, নিখোঁজের এক দিন পর পঞ্চগড়ে উদ্ধার হওয়া এই খতিবের ঘটনায় সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় উগ্রতা, উসকানি ও অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে সমন্বিত তদন্ত শুরু করেছে।
জেলা জামায়াতের বিবৃতি
পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান বৃহস্পতিবার ভোরে টঙ্গী মরকুনের বিটিসিএল টিএন্ডটি কলোনি জামে মসজিদের ইমাম আলহাজ ক্বারি মুফতি মহিবুল্লাহ মিয়াজীকে (৬০) নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর পঞ্চগড় সদর উপজেলার হেলিপোর্টের নির্জন এলাকা থেকে শিকলে হাত বাঁধা অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। উদ্ধারের পর তাকে সদর আধুনিক হাসপাতালের ভর্তি করা হয়েছে। পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালের সিভিল সার্জন মিজানুর রহমান জানান, মুফতি মহিবুল্লাহকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তিনি সুস্থ আছেন। উল্লেখ্য যে, তার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটি দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয়েছিল। এ ঘটনার পিছনে শক্তিশালী দুষ্ট চক্র রয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছেন পঞ্চগড় জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা ইকবাল হোসাইন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা জামায়াতের প্রচার বিভাগীয় সেক্রেটারি শাহীদ আল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ঘটনা পরম্পরায় স্পষ্ট বুঝা যায়, এর পিছনে শক্তিশালী কোন দুষ্ট চক্র রয়েছে। আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানাই, প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে দুষ্কৃতিকারীদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
বিবৃতিতে পঞ্চগড় জেলা আমীর মাওঃ ইকবাল হোসাইন বলেন আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্নের সাথে এই ঘটনাটিকে দেখছি। অবাক করার বিষয়, সুদূর টঙ্গীতে অপহরণকৃত ইমামকে সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ে পাওয়া গেলো কিভাবে? একজন ইমাম তার দায়িত্ব থেকেই জুমুয়ার খুতবায় পৌত্তলিকতার বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্র এবং নানা ধরণের মুসলিম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সচেতনতার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপরই অপহরণের ঘটনাটি ঘটে বলে জ্ঞান ফেরার পর ইমাম সাহেব জানিয়েছেন। এ ঘটনা আমাদেরকে অনেক কিছুর দিকেই ইঙ্গিত করছে। ইসলাম বিরোধী চক্রান্ত এবং আলেম-ওলামাদের উপর সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে পতিত ফ্যাসীবাদী সরকার। ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি আশা করেছিলাম কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনো ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এ কালো শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। আমরা চাই নিরাপদ এবং শান্তি-শৃঙ্খলার একটি বাংলাদেশ।
ঘটনা পরম্পরায় ষ্পষ্ট বুঝা যায়, এর পিছনে শক্তিশালী কোন দুষ্ট চক্র রয়েছে। আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানাই, প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে দুষ্কৃতিকারীদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সকালে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হেলিবোর্ড এলাকায় একটি গাছের সঙ্গে শেকল দিয়ে হাত-পা বাধা অবস্থায় তাকে দেখতে পায় স্থানীয়রা। পরে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
জানা গেছে, ইমাম মহিবুল্লাহ জুমার খুৎবায় সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক মূল্যবোধ ও উগ্রপন্থি সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে ১২ বার চিঠি দিয়ে হুমকি পান। সর্বশেষ ২১ অক্টোবরও তাকে হুমকি দেওয়া হয়। এর পরদিন, ২২ অক্টোবর (বুধবার) তিনি নিখোঁজ হন।
এদিকে ইমামের স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিতে হাসপাতালে আসেন জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান মুনসী, জামায়াতে ইসলামীর জেলা আমির ইকবাল হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান মুনশী জানান, স্থানীয়দের ফোন পেয়ে মুফতি মহিবুল্লাহকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার অপহরণের ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
ইস্কনকে নিষিদ্ধের দাবিতে
পঞ্চগড়ে বিক্ষোভ
পঞ্চগড় সংবাদদাতা : উগ্র হিন্দুবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইস্কন কর্তৃক মুফতি মুহিবুল্রাহ মিয়াজীকে অপহরণের প্রতিবাদ দোষীদের গ্রেফতার এবং ইস্কনকে নিষিদ্ধের দাবিতে পঞ্চগড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ঈমান আক্কিদা রক্ষা কমিটি। বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড় থেকে পঞ্চগড় ঈমান আক্কিদা রক্ষা কমিটির আয়োজনে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এতে মুসল্লিরা অংশ নেন।
মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই জায়গায় এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সংক্ষপ্তি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল হাই, ক্বারি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, মাওলানা মীর মোর্শেদ তুহিন, মাওলানা সৈয়দ মু. সুলতান মাহমুদ ও হাফেজ মো. শিহাব উদ্দিন সহ প্রমুখ। এসময় বক্তারা বলেন, উগ্র হিন্দুবাদী সন্ত্রাসীরা গত মঙ্গলবার টঙ্গি থেকে আমাদের মিয়াজী হুজুরকে অপহরণ করে এবং তাকে বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার জুলুম করে বৃহস্পতিবার ভোরে পঞ্চগড়ের হিলি প্যাড নামক এলাকায় এনে ফেলে দেয়। পরে স্থানীয় ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বক্তারা বলেন, অবিলম্বে মুফতি মুহিবুল্লাহ মিয়াজীর অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার ও উগ্র হিন্দুবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইস্কনকে নিষিদ্ধের দাবি জানান। দাবি মানা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।