মাত্র ১২০ টাকার সরকারি ফি দিয়ে কোনো তদবির বা ঘুষ ছাড়াই গাজীপুর জেলায় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেয়েছেন ৪৭ জন বেকার তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে ৪১ জন ছেলে ও ৬ জন মেয়ে। উত্তীর্ণদের মধ্যে কেউ কেউ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, চা দোকানি কিংবা দিনমজুর পরিবারের সন্তান। অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন আরও ৯ জন।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর পুলিশ লাইন্সের ড্রিল শেডে নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার ও নিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক। উপস্থিত ছিলেন নিয়োগ বোর্ডের সদস্য, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহেল রানা, গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) আমিনুল ইসলাম, পুলিশ লাইন্সের আর ও আই মিজানুর রহমান ও আর ও-১ এ কে এম আমিনুল ইসলাম।

ফলাফল ঘোষণার সময় নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রায় সব প্রার্থী ও তাদের অভিভাবকগণ উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশ সুপার বলেন, “নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোটাও ছিল, কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ না হওয়ায় ৪৭ জনকেই মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ স্বচ্ছ রাখতে গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়, যাতে কেউ দালালের খপ্পরে না পড়ে।”

তিনি আরও বলেন, “এই ৪৭ জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত। তাদের মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকা নির্ধারণ হবে। যদি কেউ বাদ পড়ে, তাহলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে।”

প্রবেশনারি পুলিশ সদস্যদের জীবনে এ নিয়োগ এক মোড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে—

আমিলুল ইসলাম সাগর, গাজীপুর মহানগরের শিমুলতলী কলেজ গেট এলাকার মৃত আবু তাহেরের ছেলে। ফলাফলে প্রথম হয়েছেন। বলেন, “আমার মা গৃহিণী। পরিবারে কেউ উপার্জনক্ষম ছিল না। মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়ে খুবই আনন্দিত।”

ঋতু রানী দাস, কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের নয়ন বাজার এলাকার বাসিন্দা। বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। আবেগভরে বলেন, “আমার বাবা সবসময় চাইতেন আমি যেন পুলিশ হই। আজ আমি পুলিশ হয়েছি, কিন্তু বাবা দেখে যেতে পারলেন না।” তিনি আরও জানান, লিখিত পরীক্ষায় ফেল করেছে ভেবে তিনি চলে গিয়েছিলেন। পরে ফোনে উত্তীর্ণ হওয়ার খবর পেয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন।

সিমেন আক্তার রিমি, শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা রফিক শেখ বলেন, “যখন পুলিশ সদস্য আমাদের বাড়িতে তদন্তে আসে, তাকে অনেক অনুরোধ করেও এক গ্লাস পানিও খাওয়াতে পারিনি। এত স্বচ্ছভাবে নিয়োগ দেখে সত্যিই গর্ব হচ্ছে।”

আবির হোসেন, কালিয়াকৈরের ঢাকাশ্বর এলাকার ইলেকট্রিক মিস্ত্রির ছেলে। নিজেও একই পেশায় কাজ করতেন। বলেন, “পরিবারের কষ্ট ঘোচাতে এবং দেশের জন্য কিছু করতে আমি এই চাকরিটা চেয়েছিলাম। আজ সেটা সত্যি হলো।”

মনিরুজ্জামান মাহিম, কালিয়াকৈরের শফিপুরের বাসিন্দা। তার বাবা আব্দুর রশিদ গ্যারেজে কাজ করেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ছেলেকে আবেদন করতে বলেন। মাহিম বলেন, “কোনো তদবির ছাড়াই আমি শুধু পরীক্ষা দিয়েছি, আর এখন আমি পুলিশের সদস্য। বাবা-মা গর্বিত, আমিও গর্বিত।”

জেলা পুলিশ সুপার ড. যাবের সাদেক বলেন, “আমরা প্রমাণ করেছি—যোগ্যতা, সততা আর স্বচ্ছতা থাকলে কারো পেছনে ঘুরতে হয় না, ঘুষ লাগেনা, দালাল লাগেনা। গাজীপুরের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া দেশের জন্য একটি মডেল হয়ে থাকবে।”