মো.মনির হোসেন, ইসলামপুর (জামালপুর) : জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার কাঁসারীপাড়া। ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পটির জন্য খ্যাত ছিল। এক সময় দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানী হতো পণ্যটি। তবে সেই চিত্র এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। ঐহিত্যবাহী এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা। বিংশ শতাব্দীতে কোনো বিয়ে-সাদি, আকিকাসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো কাঁসার জিনিসপত্র। তখন নানা কারণে ক্রমেই কাঁসার জিনিসপত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হিন্দু পরিবারগুলোর অন্যতম প্রিয় পণ্য ছিল এই কাঁসার তৈরী জিনিসপত্র। সারাদেশে থেকে ব্যবসায়ীরা কাঁসা সামগ্রী কিনতে ভিড় জমাতো ইসলামপুরে। কারখানাগুলোতে কারিগররা দিনরাত কাজ করেও কাঁসা সামগ্রী সরবরাহে হিমশিম খেতো।
জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম নামক শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রদর্শীতে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের প্রয়াত কাঁসা-শিল্পী জগৎচন্দ্র কর্মকার কারুকার্যপূর্ণ কাঁসা শিল্পটির প্রদর্শন করেন। ওই প্রদর্শনীতে ইসলামাপুরের কাঁসা শিল্প সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশ্ব বিখ্যাত শিল্প হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেছিল। তারপর থেকে সারা বিশ্বে কাঁসা শিল্পের পরিচিতি লাভ করে। সে সময় দিনে দিনে কাঁসার শিল্পের আরও চাহিদা বেড়ে যায়। কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
বাংলার এ মিশ্র ধাতব শিল্পটি কখন কোথায় কিভাবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে সুনিদিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও অনুসন্ধান করতে গিয়ে শিল্প গবেষণা নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে এটা একটি প্রাচীন আমলের সভ্যতা। ওই আমলেও ব্রোঞ্জ শিল্প ছিল। আবার কেউ কেউ পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ততাও করতে চান। আবার অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পীরা এই শিল্পটিকে রামায়ন মহাভারতের যুগের বলে মনে করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতবর্ষে পূর্ববাংলার ঢাকার ধামরাই এলাকায় কাঁসার শিল্পী এসে বসতি স্থাপন করে কারখানা গড়ে তোলেন। পরবর্তী কালক্রমে বিভিন্ন কারণে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। কাঁসা শিল্পীরা তাদের লাভজনক পেশা হওয়ার পেশাগত শিল্পজীবন পারিবারিকভাবে গড়ে তোলার কারণে একই পাড়া-মহল্লায় বসবাস করতেন। তাই তাদের বসবাসকারী এলাকাকে কাঁসারি পাড়া নামে পরিচিতি লাভ করে ছিল। ভারতবর্ষে কাঁসা দিয়ে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করে ব্যবহার করে আসছিল বলে সে সময় জটিল কোন রোগবালাই ছিল না। বর্তমানে টিন, অ্যানুমিনিয়ামের ব্যবহারে নতুন নতুন রোগের আবিভার্ব ঘটেছে বলে দাবি করছেন কাঁসা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। কাঁসা তৈরীর বিভিন্ন উপকরণ ও পণ্যেও দাম বেড়ে যাওয়ায় ও প্লাস্টিক পণ্যেও সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় এটি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। তা ছাড়া ক্রেতারা উচ্চমূল্যে এটি খরিদ করতে চান না, তেমনি করে কারিগর ও শিল্পীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের বর্তমানে দুর্দিন চলছে। অনেকেই বাঁচার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ শিল্পটি ঢাকাই মসলিনের মতো বিলীন হয়ে যাবে।
নানা সংকটেও ৮টি প্রতিষ্ঠান ইসলামপুরের কাঁসা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখার স্বার্থে কাঁসারীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ আর শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানীর সুযোগ করে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
ইসলামপুর বাজারের কাঁসা তৈরীর প্রতিষ্ঠান দূর্গা বাসনালয়ের মালিক নারায়ণ কর্মকার জানান, আমি পারিবারিকভাবে এ প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছি। সময়ের পরিবর্তনে অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে পেশায় যুক্ত হয়েছেন। এ পেশাটি টিকিয়ে রাখতে আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।