ইকবাল হোসেন, শ্রীপুর (গাজীপুর) সংবাদদাতা : গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহলাদপুর ইউনিয়নের ডুমনী বিলের নরম পানিতে আজ ভাসছে এক তরুণের স্বপ্ন। সেই বিলের পাড়ে গড়ে ওঠা ভাসমান হাঁসের খামারটি শুধু একটি ব্যবসা নয়-এটি এক তরুণের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অধ্যবসায়ের গল্প। ২৫ বছর বয়সী তাপস দাস, একসময় বেকার ছিলেন। আজ তিনি এলাকার সফল তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম।

অর্থনৈতিক কষ্টে তাপসের পড়াশোনা খুব বেশি দূর এগোয়নি। ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় গিয়ে একটি কারখানায় চাকরি নেন। চলছিল ছোট্ট সংসার, কিন্তু ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় চাকরি হারান তিনি। জীবনের মোড়ে এসে তখন দুটি পথ-বিদেশে পাড়ি দেওয়া, নাকি নিজের মাটিতে কিছু করে টিকে থাকা।

পরিবার চেয়েছিল তাপসকে বিদেশে পাঠাতে, কিন্তু ছয় লাখ টাকার প্রয়োজনীয় খরচ জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তাপসও ঠিক করলেন, বিদেশে নয়-নিজের দেশেই ভাগ্য বদলাবেন। ছোটবেলা থেকেই পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় তাঁর হাঁস পালনের আগ্রহ।

২০২১ সালে মাত্র দেড় হাজার টাকা মূলধন দিয়ে ৩২টি খাকি ক্যাম্পবেল জাতের হাঁস কিনে বাড়ির পাশে ছোট করে শুরু করেন তাঁর প্রথম হাঁসের খামার। কোনো প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু ইউটিউব আর অনলাইন ভিডিও দেখে শিখতে থাকেন হাঁস পালন, রোগব্যবস্থাপনা, খাবার তৈরি, এমনকি বাজারজাত করার কৌশলও।

তাপসের পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফল মিলতে শুরু করে এক বছরের মাথায়। ছোট খামারটি বড় হতে থাকে, ডিম বিক্রি থেকে আয়ও বাড়তে থাকে। বর্তমানে তাঁর খামারে রয়েছে প্রায় ৪৫০টিরও বেশি হাঁস, প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ২৫০টিরও বেশি ডিম। স্থানীয় পাইকাররা সরাসরি তাঁর বাড়ি থেকে ডিম কিনে নিয়ে যান।

তাঁর খামারটি স্থাপিত হয়েছে ডুমনি বিলের উন্মুক্ত পানিতে। সারাদিন হাঁসগুলো পানিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে পাশে টিন ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি ঘরে। কম খরচে বেশি উৎপাদন, এটাই তাপসের খামারের মূল শক্তি। মাসে তিনি এখন গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় করেন, যা দিয়ে নিজের পরিবারের পাশাপাশি ভবিষ্যতের স্বপ্নও গড়ে তুলছেন।

তাপস বলেন, “লাভ সবসময় একই রকম থাকে না, ঝুঁকিও আছে। হাঁস অসুস্থ হলে ক্ষতি হয়। কিন্তু আমি থেমে যাইনি। সরকারি সহযোগিতা পেলে আরও বড় পরিসরে খামার গড়ে তুলতে পারব।” তাপসের মা সবিতা রানী দাস বলেন, “প্রথমে আমরা ভয় পেয়েছিলাম, ও পারবে কিনা সন্দেহ ছিল। কিন্তু ওর ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমেই আজ আমরা গর্বিত। ছেলেটা এখন অনেকের অনুপ্রেরণা।” স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তা শেখ ফরিদ বলেন,“তাপস প্রমাণ করেছে, বিদেশে না গিয়েও নিজের মাটিতেই সাফল্য পাওয়া যায়। আমাদের এলাকার শিক্ষিত বেকার তরুণরা যদি তার মতো চিন্তা করত, তাহলে বেকারত্ব অনেকটাই কমে যেত।”

শ্রীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আশরাফ হোসেন বলেন,“তাপসের মতো উদ্যোক্তারা সমাজে নতুন দিগন্ত খুলে দেন। আমরা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে তাঁকে প্রশিক্ষণ, টেকনিক্যাল সহায়তা এবং প্রণোদনার আওতায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছি। তাঁর মতো তরুণরা দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারেন।”

বর্তমানে তাপস শুধু নিজের নয়, আশপাশের আরও কয়েকজন তরুণকে হাঁস পালনে উদ্বুদ্ধ করছেন। অনেকে তাঁর পরামর্শে ছোট খামার শুরু করেছেন। তাপস এখন চান নিজের খামারকে আরও বড় করে বাণিজ্যিক পরিসরে সম্প্রসারণ করতে। দিন শেষে বিলের ঢেউয়ে যখন হাঁসেরা ফিরে আসে খামারে, তাপস দাঁড়িয়ে থাকেন পাড়ে-মুখে তৃপ্তির হাসি। তিনি জানেন, এ শুধু হাঁসের খামার নয়, এটি তাঁর স্বপ্ন, সংগ্রাম ও সাফল্যের প্রতীক।