খুলনা বিভাগের ১০ জেলার অধিকাংশ ইটের ভাটায় নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। নিয়ম নীতিমালা উপেক্ষা করে প্রভাবশালীদের আগ্রাসনে চালিয়ে যাচ্ছে ইটভাটা। পাশাপাশি এসব ইটভাটার ব্যবসায় প্রভাবশালী মহল সংশ্লিষ্টতা থাকায় নীরব ভূমিকায় স্থানীয়রা। ইটভাটার চিমনি থেকে নির্গত এই কালো ধোঁয়া দিনের পর দিন উত্তপ্ত করে তুলছে পরিবেশ। যেনো জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারো। ইটের ভাটা স্থাপন থেকে শুরু করে ইট প্রস্তুতির প্রক্রিয়া কোনো কিছুই পরিবেশ বান্ধব নয়। বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণ বা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিক নিয়ে ভাবতে গেলে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ইটের ভাটা। এই ইটের ভাটাগুলো তিলে তিলে মানুষের শরীরে রোগের আবাসস্থান তৈরী করছে। শত বছরের পুরোনো পদ্ধতিতে ভাটা পরিচালনাই এই ক্ষতির মূল কারণ। সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া বাজারের একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে ইট তৈরীর বিশাল কর্মযজ্ঞ। জাহান ব্রিকস নামে এই ভাটার আশপাশে চোখে পড়বে বহু লোকালয়-বাজার। এখানে আবার নি¤œমানের কয়লার সাথে কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে চুল্লিতে। এভাবে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করেই খুলনা বিভাগের বহু ইটের ভাটা স্থাপন করা হয়েছে জনবহুল এলাকার পাশে বা কৃষি জমিতে। মূলত প্রভাবশালী মালিক পক্ষের সুবিধার কথা বিবেচনা করে এসব ভাটা স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে নদীর জায়গা, কৃষিজমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে হওয়ায় এবছর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া এলাকার ১৮টি ভাটাকে পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সদ্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী নরায়ণ চন্দ্র চন্দ ছিলেন খুলনা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি। ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া নদী দখল করে অবৈধ ইটভাটা নির্মাণ করে অবলীলায় পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। যদিও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে বন্ধ রয়েছে এই ইটের ভাটা। এছাড়াও ডুমুরিয়া এলাকায় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ থাকায় বেশ কিছু ইটভাটার বিরুদ্ধে কেউ কখনো মুখ খুলতে সাহস পাননি। এই ইট ভাটাগুলো লোকালয় থেকে দূরে সরানোর দাবি সাধারণ মানুষের ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সচেতন নাগরীক সৈয়দ আলী হাকিম বলেন, এসব ভাটা যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন এখানে কাজ করা হাজারো শ্রমিক। এছাড়াও মাটি থেকে একটি ইট তৈরী করতে শ্রমিকদের যে পরিশ্রম হয় সে অনুযায়ী তারা পান না পারিশ্রমিক। সংসারের তাড়না তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভুলতে বাধ্য করেছে। ইটভাটায় ইট তৈরীতে ব্যবহার করা হচ্ছে আবাদি জমির উপরিভাগ, নদীর তীর এবং পাহাড়ের মাটি, যা আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জ¦ালানি হিসাবে কাঠের ব্যবহার ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইনে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হলেও অনেক জায়গায় তা মানা হচ্ছে না। এছাড়াও ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হয় আমদানিকৃত নিম্নমানের কয়লা। এ কয়লা পোড়ানোর ফলে প্রচুর পরিমাণ ছাই তৈরি হয়। অন্যদিকে ইটভাটা থেকে বায়ুমন্ডলে নানা দূষিত উপাদানও যোগ হচ্ছে। এসব দূষিত উপাদানের মধ্যে রয়েছে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড। গবেষণায় দেখা গেছে, পার্টিকুলেট ম্যাটার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব উপাদান মানবদেহে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করলে রেসপিরেটরি সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কৃষিজমির ওপরও ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। জমির উর্বরতা শক্তি কমছে। কাজেই সব দিক বিবেচনা করে ইটের পরিবর্তে ব্লকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খুলনা বিভাগে মোট ইটভাটার ৬৬ শতাংশই অবৈধ। এদের অনেকের ইটভাটা হিসেবে নিবন্ধন থাকলেও নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের দশ জেলায় ১ হাজার ১৮টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৭৯০টি ইটভাটারই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন। বিভাগে সব থেকে বেশি ইটভাটা রয়েছে কুষ্টিয়ায়। যেখানে মোট ইটভাটার পরিমান ১৮৪টি। তবে এর মধ্যে ১৬৩টি ইটভাটারই নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। একই অবস্থা পুরো বিভাগ জুড়ে। এ ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক রাজীবন কুমার বাইন বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড় পত্র ছাড়া যেসব ইটভাটা চলছে তার একটি তালিকা তৈরি করা আছে।আমরা পর্যায়েক্রমে ব্যবস্থা নিব।