রাজবাড়ী সংবাদদাতা : দেশ-বিদেশে আলোচিত রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও কবর থেকে লাশ তুলে নিয়ে পোড়ানোর ঘটনায় বর্তমানে গোয়ালন্দে চরম গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। যদিও নুরুল হক অথবা নিহত ভক্তের পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোন মামলা দায়ের করা হয়নি।

তবে পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর ও সরকারী কাজে বাধাদানের মামলায় আরো ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত রোববার এ ঘটনায় আরো ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো, গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ময়ছের মাতুব্বার পাড়া গ্রামের মো. শওকত সরদারের ছেলে জীবন সরদার (২০), গোয়ালন্দ পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের আ. মালেক ফকিরের ছেলে সাগর ফকির (২১), ৯নং ওয়ার্ডের হেলাল উদ্দিনের শেখের ছেলে সাইফুল ইসলাম শুভ (১৯), ফরিদপুর কোতায়ালী থানার ইশন গোপালপুর ইউনিয়নের ডিগ্রীরচর গ্রামের মো. নিজামউদ্দিনের ছেলে মো. ফেরদৌস সরদার (৩৬) ও গোয়ালন্দ পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের আদর্শ গ্রামের মো. আব্দুস সালাম খার ছেলে মো. বিপ্লব বিল্লু (২৮)।

ঘটনাস্থল গোয়ালন্দ দরবার পরিদর্শনে গত সোমবার এসেছিলেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) মো. সিদ্দিকুর রহমান, রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম প্রমুখ। এসময় ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে এত বড় ঘটনা ঘটবে আমরা তা ভাবিনি। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে আমরা বদ্ধ পরিকর। তিনি আরো জানান, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ কোন গণগ্রেপ্তার করছে না। প্রাথমিকভাবে অপরাধে প্রমান পাওয়া গেলে কেবল তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। অজ্ঞাত আসামি করে মামলা মানে এই নয় যে, যাকে তাকে গ্রেফতার করা হবে। স্পষ্ট ভিডিও প্রমাণ ও স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হবে। সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখানে যারা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, সে সময় আমাদের পোশাকধারী পুলিশ এবং সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় ছিল। তবে সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ ছিল, সবাই হামলার সাথে জড়িত নয়। শুধু যারা হামলার সাথে জড়িত তাদেরই আটক হবে।

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধনের জন্য জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ দফায় দফায় বৈঠক করে। কিন্তু ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ৪ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কক্ষে দাবি পূরণের প্রমাণস্বরূপ ভিডিও ও ছবি দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। শুক্রবার যেহেতু শুধু সমাবেশ ছিল, কিন্তু সেই সমাবেশ থেকে একদল উগ্রবাদী তাদের নেতাদের নির্দেশ অমান্য করে প্রথমে পুলিশের উপর হামলা চালায়, এরপর মাজার ভাঙচুর, কবর থেকে লাশ তুলে অগ্নিসংযোগ ও মাজারে লুটপাট করে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে গোয়ালন্দ ঘাট থানার এসআই মো. সেলিম মোল্লা বাদি হয়ে পুলিশের উপর হামলা, সরকারী কাজে বাধা প্রদান ও সরকারী সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ এনে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার অজ্ঞাত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

থানা পুলিশ সূত্র জানায়, নুরাল পাগলের কবর উচু থেকে নিচু করাসহ বিভিন্নদাবিতে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) জুম্মার নামাজের পর ইমান আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফকীর মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দেয়া হয়। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা দরবারের দিকে যেতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন ও থানা পুলিশ তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সরকারী গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি’র গাড়ি ভাংচুর করে। সেই সাথে ৫ পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় প্রশাসনের ২জনকে পিটিয়ে ও ঢিল ছুঁড়ে আহত করে। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা নুরাল পাগলের বাড়ীর গেট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে ভবন ও দরবারে ভাংচুর চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশত মানুষ আহত হয়। এক পর্যায়ে তৌহিদী জনতা নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ওইদিন রাতেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ঘটনায় আহত নুরাল পাগলের ভক্ত রাসেল মোল্লা (২৮) নামে এক ব্যাক্তি নিহত হয়।

গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম বলেন, ফুটেজ পর্যালোচনা করে রোববার দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে গোয়ালন্দ থানার বিভিন্নস্থান থেকে পুলিশের উপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুর মামলায় ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে এ মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত আছে। তবে এখন পর্যন্ত নুরাল পাগলের মাজার ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও নিহতের ঘটনায় কোন মামলা হয় নাই।

এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের আমীর এ্যাড. নুরুল ইসলাম জানান, তিনি এবং তার দল দরবারে হামলা ঠেকানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এছাড়া ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হাফেজ মাওলানা মোঃ ইলিয়াস মোল্লা আগেই সকল শাখাকে মিছিল না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি ঘটনার দিন নুরাল পাগলার বাড়ি পরিদর্শন করে মিডিয়ার সামনেই মিছিলের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছি, যা বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়েছে। এ ধরনে হামলা ও কবর থেকে লাশ তুলে পোড়ানো অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত যা তারা সমর্থন করেন না।