সুন্দরবনে চলমান তিন মাসের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থেমে নেই হরিণ শিকার। সাম্প্রতিক সময়ে বনের চারপাশে এক নতুন ভোক্তা শ্রেণির উত্থানের ফলে হরিণের মাংসের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিকারি চক্রগুলোর কার্যক্রমকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। বন বিভাগের নজরদারি এড়াতে তারা নিয়মিত নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। উদাহরণস্বরূপ, দৃশ্যমান নাইলনের রশির পরিবর্তে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে স্টেইনলেস স্টিলের তার, যা সুন্দরবনের আলো-ছায়ার পরিবেশে প্রায় অদৃশ্য। সম্প্রতি চেতনানাশক স্প্রে টোপ হিসেবেও ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে।

মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের আওতাধীন বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মোংলা, রামপাল, খুলনার দাকোপ এবং বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় একাধিক পেশাদার হরিণ শিকারি চক্র সক্রিয় রয়েছে। ১ জুন থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও বর্তমানে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে হরিণ শিকারের ফাঁদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গত দেড় মাসে বন বিভাগ ৪২ কেজি হরিণের মাংস এবং তিনটি হরিণের কাটা মাথা উদ্ধার করেছে। একই সময়ে ৬ হাজার ১১২টি ‘হাটা’ ফাঁদ এবং ১৭৮টি ‘ছিটকা’ ফাঁদ অপসারণ করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে সাতটি মামলা, ইউডিওআর ১৬টি এবং ওসিআর ১১টি মামলা দায়ের হয়েছে। অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে ২৯ জনকে আটক এবং ২৭টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও নৌকা জব্দ করা হয়েছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি শিকারিদের পক্ষে কাজ করছে। শেষ তিন দিনে আটক হওয়া ১৯ জন নিজেদের মাছ চোর দাবি করলেও, তাদের হরিণ শিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কি না তা তদন্তাধীন। শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জের সোনাতলা, পূর্ব খুড়িয়াখালী, দাসের ভাড়ানী, চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া, কাঁঠালতলা, রামপাল, মোংলা এবং দাকোপসহ আশপাশের এলাকায় শিকারি চক্রগুলো সক্রিয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কিছু রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহল এই অবৈধ কার্যক্রমে মদদ দিচ্ছে। বিশেষ অনুষ্ঠান, আপ্যায়ন বা ঘুষ হিসেবে হরিণের মাংস ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। প্রতি কেজি মাংস ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়, অনেক সময় চামড়াসহ মাংস সরবরাহ করা হয়। একটি অবৈধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সিন্ডিকেট সদস্যরা সহজেই মাংস সংগ্রহ করে থাকে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক সংগ্রামকে জানান, কচিপাতা বা ডালে চেতনানাশক স্প্রে ব্যবহার করলে তা নদীতে ফেলে দেওয়া বা মাটিতে পুঁতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ‘প্যারালাল লাইন সার্চিং’ পদ্ধতিতে বিপুলসংখ্যক ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “প্রতি বনরক্ষীকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর বন পাহারা দিতে হয়-এটি বাস্তবসম্মত নয়। সুন্দরবন রক্ষায় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা কমানোর উদ্যোগ জরুরি।”