এবিএম ফজলুর রহমান, পাবনা : অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, মানুষের কাছে ঘৃনিত পোকা চাষ করে নিজের ভাগ্যে বদলে ফেলেছেন পাবনার আটঘরিয়ার পারসিধাই গ্রামের যুবক শিমুল হোসেন। ‘এক সময়ে যে ছিল সবার কাছে অবহেলার পাত্র সে এখন সমাজের সবার আইডল’। পোকা চাষ করে মাত্র চার বছরে পরিশোধ করেছেন ১৬ লাখ টাকার ঋণ। নিজ এলাকা আর কক্সবাজারে গড়ে তুলেছেন আরও দুটি নতুন খামার। সব খরচ বাদে এখন মাসে তার আয় অন্তত দেড় থেকে ২ লাখ টাকা।
শিমুল জানান, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই দেখতে মাছির মতো। এটি মূলত মাছি-জাতীয় প্রাণীর লার্ভা। আকারে মাছির তুলনায় কিছুটা লম্বা। ময়লা-আবর্জনা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ও হোটেলের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা মূলত ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নামক পোকার খাবার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছ ও পোলট্রির প্রচলিত খাদ্যের বিপরীতে ব্ল্যাক সোলজারই হবে আগামীর বিকল্প। কারণ এর পুষ্টিমান ও খরচ তুলনামূলক ভাবে কম। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রয়েছে ব্যাপক অবদান।
এক সময় হতাশায় ডুবে যেতে বসা শিমুলের মতো আরও অনেক উদ্যোক্তা এখন পোকার খামার করে জীবন-সংসারের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। পাবনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকায় চাকরি করতেন শিমুল। ‘তখন থেকেই কৃষিতে নিজে কিছু করার পরিকল্পনা ছিল তার। চাকুরিতে তেমন সুবিধা করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে ২০১৮ সালে বাড়িতে এসে হাঁস পালন শুরু করেন। নতুন হওয়ার কারণে ১৮ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে পড়েন; বলেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
তবে ইউটিউব ভিডিও দেখে ব্ল্যাক সোলজার চাষের আগ্রহ থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নেন শিমুল। এরপর বাজার ব্যবস্থা নিয়ে নিজেই খোঁজ খবর নেন। পরিকল্পনা করেন এই পোকা চাষের।
এর মধ্যে পাবনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রোগ্রাম ফরকমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (পিসিডি) বাস্তবায়িত রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট থেকে ঋণ ও আবার নতুন করে প্রশিক্ষণ নেন। এ ছাড়া পিসিডি মার্কেট চেইন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেন।
মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ান শিমুল। প্রথম দিনে এখন ৩০০ কেজি (বাজার মূল্য ৮০ টাকা কেজি হলে ৭২ হাজার টাকা) লার্ভা উৎপাদন করেন। এগুলো বিক্রি করেন স্থানীয় বাজার ও ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে। এ ভাবে শিমুল এখন কক্সবাজারে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় বড় আকারের ফার্ম করছেন।
তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘ পোকা চাষের কারণে স্থানীয়রা এক সময় আমাকে পাগল ভাবত। কিন্তু কিছুদিন আগে আমি ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে মাদার পোকা (পিউপা) রপ্তানি করেছি। উদ্যোক্তারা ওই সব দেশেও এই পোকার খামার করেছেন।’
পাবনা জেলা মৎস কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল জানান, প্রচলিত বাজারে মাছ ও পোলট্রি খাবারের প্যাকেটে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে। কিন্তু ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ে প্রোটিনের পরিমাণ ৪৩ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণে দেশে ক্রমেই মাছ ও পোলট্রির খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে এই পোকা। এর উৎপাদন খরচও কম। এক কেজি পোকার উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ১২ টাকা। বিক্রি হয় সময় ভেদে ৫০ থকে ৮০ টাকা কেজি।
কৃষি বান্ধব অর্থনীতি কিংবা গ্রামীণ সমাজ উন্নয়নে শিমুলের মতো উদ্যোক্তাদের সব রকমের সহযোগিতার কথা জানান পাবনার পিসিডি নির্বাহী পরিচালক মো.শফিকুল আলম।
পিসিডি নির্বাহী পরিচালক মো.শফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা পেয়ে শিমুল এখন দেশ সেরা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদনকারী। এমন অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি আমরা। তাদের হাত ধরে আগামীর গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই তার উদাহরণ মাত্র।’