মোঃ একরামুল হক, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) : একসময় বর্ষা এলেই চট্টগ্রামের হাটহাজারীর খাল, বিল, পুকুর আর নদীগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেত। ঘরে ঘরে দেশি মাছ ভাজার সুগন্ধ, হাটে-বাজারে মাছের পসরা আর জেলেদের মুখে হাসিÍএই ছিল চিরচেনা দৃশ্য। কিন্তু সেই সোনালি দিন এখন শুধুই স্মৃতি। বর্তমান বাস্তবতা হলো, ভরা বর্ষা মৌসুমেও হাটহাজারীতে দেশি মাছের তীব্র সংকট। বাজারে চোখ রাখলে এখন চোখে পড়ে শুধু চাষের তেলাপিয়া, পাঙ্গাস আর কার্প জাতীয় মাছ। অথচ একসময় এসবের জায়গা ছিল পুঁটি, শিং, মাগুর, কৈ, টেংরা, চেং, গজার, বেলে কিংবা টাকি মাছের দখলে।
জেলে পরিবারগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। এককালের মাছের আধার হিসেবে পরিচিত হালদা নদী, কাটাখালী খাল, দক্ষিণ মাদার্শা খাল, দারোগারহাট সংলগ্ন জলাশয়, হালদা-মগদাই বিল, ফতেয়াবাদ বিল, মির্জাপুর বিল, গুমানমর্দন বিল, চারিয়া বিল, নাকারকুল বিল, ফটিকা বিল এবং আলাইম্মার কুম সহ অসংখ্য প্রাকৃতিক জলাধার এখন মাছশূন্য। অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ জাল ফেলেও মাছের দেখা মেলে না।
জাতে জেলে বাবুল জলদাশ বলেন, “বর্ষায় যে সময়টাতে প্রতিদিন মাছ ধরে ঘরে ফিরতাম, এখন সেই সময় বসে থাকতে হয় শূন্য জাল হাতে।” তিনি জানান, তার দাদী কামিনী জলদাশ আশির দশকে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি মাছ বিক্রি করতেন। তার বাবা যোগেশ জলদাশও এই পেশায় থেকে সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন তাদের কেউ আর এই পেশায় নেই। বাবুল নিজে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন এবং পরিবারের বাকি সদস্যরাও অন্যান্য পেশায় চলে গেছেন।
চারিয়া সিকদার পাড়ার আবদুল ওহাব বলেন এখন মাছের ডালা (মৌসুম) চলছে চিংড়ির সাথে আরো কত ধরনের মাছ পেতাম আগে এখন খালি হাতে ফেরত যাচ্ছি হালদার শাখা খালে মাছ নেই বললে চলে।
দেশি মাছের এই সংকটের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হলো কৃষিক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। চাষাবাদের এই বিষাক্ত উপকরণগুলো বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে খাল-বিল ও পুকুরে গিয়ে পড়ে, যা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য, ডিম ও পোনা ধ্বংস করে। এসব রাসায়নিক উপাদান জলজ জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যও নষ্ট করে দিচ্ছে।
অবৈধ জালের ব্যবহারও মাছের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মশারি ও কারেন্ট জালের মতো নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের ফলে মাছের ডিম ও ছোট পোনাও ধরা পড়ছে, যা মাছের প্রজনন চক্রকে ভেঙে দিচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে মাছ বংশবিস্তার করতে না পারায় প্রতি বছর দেশি মাছের পরিমাণ কমছে। এছাড়াও, জলাশয় ভরাট, পুকুর-খাল দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন এবং নগরায়নের চাপে প্রাকৃতিক মাছের আবাসস্থলগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। হালদা ও আশপাশের খালগুলোতে গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য ফেলার কারণে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, ফলে মাছের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।