নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. মাসুদ হাসান জুয়েলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার হিসেবে বদলি করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিযার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহার হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে বদলী করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে তার নিজ জেলা চট্টগ্রাম। প্রশ্ন ওঠেছে তিনি কিভাবে নিজ জেলায় পোস্টিং পেয়েছিলেন। বিধি অনুযায়ী নিজ জেলায় পোস্টিং নেয়া অবৈধ। গত বছরের ১০ নবেম্বর ডিআইজি মো. টিপু সুলতান ও এআইজি তালেবকে ৭০ লাখ টাকা উৎকোচ প্রদানের বিনিময়ে মো. মাসুদ হাসান জুয়েলরকে চট্টগ্রাম কারাগারে বদলী করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কারা অধিদপ্তরে যোগদান করেন জুয়েল। চট্টগ্রামের ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করে চট্টগ্রামের কোটায় চাকরি নিয়েছেন তিনি। তার স্থায়ী ঠিকানা ভূঁইয়া বাড়ী, ফুলতলী, থানা: দেবীদ্বার, জেলা: কুমিল্লাতে অবস্থিত। তার পিতার নাম মো. মনিরুল হক ভূইয়া। কারারক্ষীতে ভর্তি হয়ে পদোন্নতির মাধ্যমে সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর হয়ে অবসরে যান মনিরুল। তার চাচা (অব.) সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস তাকে নিয়োগ প্রদানের জন্য সুপারিশ করে। তার ওই চাচা তখন এআইজি হিসেবে নিয়োগ বোর্ড ছিলেন। তার এনআইডিতে এখনও স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লা দেওয়া আছে। তার নিয়োগই অবৈধ বলে দাবি করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে চট্টগ্রামের কোটায় চাকরি নিয়েছেন। আবার সেই চট্টগ্রামেই চাকরি করছেন। নিজ জেলায় চাকরি করা তো বিধি অনুযায়ী অবৈধ। এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। যেখানে দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও জেল হওয়ার কথা ছিল। সেখানে তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলীর মাধ্যমে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করা হলো বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগারের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ২০০৮ সালে ছাত্রজীবনে কুমিল্লা মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন জুয়েল। তার আপন বড় বোনের জামাই প্রাক্তন সহ.প্রধান কারারক্ষী শাহীন কুমিল্লা কারাগারে কর্মরত থাকাকালীন ১ লাখ ইয়াবা বড়িসহ আটক হবার কারণে চাকুরীচ্যুত হন এবং জেল খাটেন। প্রাপ্ত অভিযোগে আরও প্রকাশ, জুয়েল এর আপন ভাই মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন কুমিল্লা নগর যুবলীগের সাথে জড়িত। তার আপন মামাতো ভাই মোহাম্মদ সালাউদ্দিন(ডিস ব্যবসায়ী), কুমিল্লার সাবেক এমপি বাহারের ঘনিষ্ট জন হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জুয়েলের এর ভাই মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন ও মামাতো ভাই মোহাম্মদ সালাউদ্দিন কুমিল্লা থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামের কারা অধিদপ্তরের জেলারের সরকারি বাসভবনে গত দুই মাস ধরে আত্মগোপন ছিলেন। এরপর নাজমুল হোসেন (মোবাইল নং ০১৭৩৯৪০২৬৪৬) কিছুদিন ভারতে আত্মগোপনে ছিলেন। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার সূচনার সঙ্গে ভারতে দেখা করেন। বর্তমানে কোথায় আছে জানা সম্ভব হয়নি।

তারা জানান, জুয়েল নিজে এককভাবে কারাগারের ক্যান্টিন পরিচালনা করেন। অতীতে ক্যান্টিনের বাজার-সদাই কারারক্ষীরা করে থাকলেও বর্তমান কারাগারের সকল বাজার জেলার নিজে করেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম কারাগারের ক্যান্টিনে ৭০ লাখ টাকা লাভ হয় বলে প্রচারিত আছে। কিন্তু জেলার ২০ লাখ টাকা লাভ দেখান। লাভের বাকি ৫০ লাখ টাকা পদস্থরা ভাগাভাগি করেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কারাগারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন জেলার জুয়েল। এ কাজে চট্টগ্রাম কারাগারের আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী বলে পরিচিত ঠিকাদার আলম ও বর্তমান জেলারের মামাতো ভাই মোহাম্মদ সালাউদ্দিন লেনদেনের বিষয়টি দফারফা করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এ অনৈতিক সুবিধাভোগীদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা বিচারাধীন বন্দী সাবেক এমপি লতিফ, সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরী, সাবেক এমপি আবু রেজা মো. নেজামুদ্দিন নদভী, সাবেক পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম ও টেকনাফ এর সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি। জেলখানা সংলগ্ন জেল রোডের আমানত শাহ(র.) মাজারের পাশে ঠিকাদার আলমের বাড়িতে বন্দীদের প্রতিনিধির সাথে চট্টগ্রাম কারাগারের পদস্থ ব্যক্তি গোপন বৈঠক করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আলমের বাড়িতে আসামীদের লোকজন গাড়ীসহ আসলে উক্ত গাড়ীতে বসে জেলার মাসুদ মিটিংসহ লেনদেনের আলোচনা সম্পন্ন করেন।

কারাগারের একটি সূত্র জানায়, এদিকে মো. এমরান (৩২),পিতা-মৃত আব্দুস ছামাদ, সাং-সেকেন্দার চেয়ারম্যান ঘাট,রমজান আলীর বাপেরবাড়ি, থানা-বাকলিয়া,জেলা চট্টগ্রাম, নামের আসামী ১ মে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে ঠিকাদার আলমের মাধ্যমে জেলার জুয়েল আসামীর বাড়ি গিয়ে পুলিশের সহযোগীতায় আসামীকে ধরে নিয়ে আসেন। আসামী পালানোর ঘটনাটি তিনি ওই সময়ে কাউকে না জানিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে আসামীকে বাকলিয়া থানার সহযোগিতায় আটক করার পর তাকে আদালতে না পাঠিয়ে সরাসরি কারাগারে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া আসামী পলানো নিয়ে থানা বা কারাগার কোন মামলাও করা হয় নাই। আসামী মো. এমরান এর পলায়নের ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে গত ১০ মে। কমিটিতে কারা কারা রয়েছেন তা জানাতে কারাগার সূত্র অপারগতা জানিয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাসুদ হাসান জুয়েলের সঙ্গে বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।