ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে গ্রেফতারে ‘রেড নোটিশ’ জারীর জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছে। বিদেশে পলাতক পুতুলের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই এই আবেদনটি করা হয়। এছাড়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ শেখ পরিবারের আরও ছয় সদস্যের বিরুদ্ধেও রেড নোটিশ জারীর পৃথক আবেদনটি প্রক্রিয়াধীন।

এর আগে শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়। বিদেশে পলাতক ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন করে এনসিবি। ওই আবেদনের ভিত্তিতে গত ১০ এপ্রিল পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারী করেছে ইন্টারপোল।

জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল রোববার রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দ দুর্নীতির মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেয় আদালত। ওইদিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এ আদেশ দেন। দুদক ও আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পুতুলের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করে দুদক। শুনানি নিয়ে আদালত তা মঞ্জুর করেন।

এর আগে ১০ এপ্রিল প্লট বরাদ্দ দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন আদালত। আর প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে করা পৃথক তিনটি মামলায় ১৩ এপ্রিল শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন আদালত। তিনটি মামলাতেই শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এবং সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদসহ ১৬ জন অভিযোগপত্রভুক্ত আসামী।

গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করে দুদক।

গত ২৯ এপ্রিল রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলার আসামী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সাত সদস্যকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানায় দুদক।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। তার মেয়ে পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের (ডব্লিউএইচওএসইএআরও) আঞ্চলিক পরিচালক। ওই দায়িত্ব পালনের জন্য তিনিও ভারতে রয়েছেন। আর বহু বছর ধরেই জয় থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।

শেখ হাসিনা যখন ভারতে পালিয়ে যান, তার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও ছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল। তবে এখন তিনি কোথায় আছেন, সে বিষয়ে হালনাগাদ কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসেনি। রেহানার ছেলেমেয়েরা ব্রিটিশ নাগরিক। তাদের মধ্যে টিউলিপ ব্রিটিশ এমপি। রূপন্তীও লন্ডনেই থাকেন। অভ্যুত্থানের আগে ববি ঢাকায় ছিলেন। এখন তিনিও দেশের বাইরে বলে কর্মকর্তাদের ধারণা।

ওই ছয় মামলার মধ্যে কয়েকটিতে ইতোমধ্যে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। এছাড়া ‘গণহত্যা’, ‘গুম’সহ তিন অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।

বাংলাদেশ আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করলেও এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।

আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর ২৬ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশের এলাকায় হাসিনা, জয়, পুতুল, রেহানা, ববি ও রূপন্তীর নামে ১০ কাঠার প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এদিকে, শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়। বিদেশে পলাতক ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন করে এনসিবি। যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়, তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, আদালত, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনাসহ যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা ও বেনজীর আহমেদ ছাড়া অন্য ১০ জনের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে এনসিবি থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় ১০ এপ্রিল। এর আগে তাঁদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে নথিপত্রসহ চিঠি পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।

শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করতে গত বছরের নভেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরকে অনুরোধ করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। এনসিবি যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছে, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালত থেকে বিভিন্ন মামলায় ওয়ারেন্ট বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।