জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলী চালিয়ে অনেককে হত্যা ও জখম করে। এ ছাড়া আহত ব্যক্তিদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সেও গুলী করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট সেবা।

গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে সাক্ষী আলী আহসান জুনায়েদ এসব কথা বলেন । ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই মামলার ৪৮তম সাক্ষী হিসেবে জুনায়েদ এই জবানবন্দি দেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের জেরা শেষে আলী আহসান জুনায়েদ জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন। কিছুক্ষণ জবানবন্দি নেওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে যান। এরপর আবার তার জবানবন্দি নেওয়ার কথা রয়েছে।

শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার বাকি দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে।

জবানবন্দিতে আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রোডের সাদ্দাম মার্কেটের সামনে অনেক আন্দোলনকারী জড়ো হয়। আমিও তাতে যুক্ত হই। সেখান থেকে মিছিলসহকারে আমরা কাজলা ফুটওভার ব্রিজের সামনে গিয়ে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাই। এসময় স্নাইপার রাইফেল দিয়ে আন্দোলনকারীদের টার্গেট করে মাথায় গুলী করা হয়।

আলী আহসান জুনায়েদ আরও বলেন, আমি প্রায় ১৫ জনকে মাথায় গুলীবিদ্ধ অবস্থায় অনাবিল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে দেখেছি। ৫ আগস্ট আমরা জানতে পারি যে, বেলা ২টার সময় সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখন আমরা আন্দোলনকারীরা বুঝতে পারি, শেখ হাসিনা সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। আমি হ্যান্ডমাইকে আন্দোলনকারীদের মাঠ ছেড়ে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই, যাতে দেশে সামরিক শাসন আসতে না পারে সেজন্য সজাগ থাকতে। বেলা আনুমানিক ৩টার সময় সেনাপ্রধান ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন।

জবানবন্দিতে জুনায়েদ জানান, সেদিন (৫ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার আশপাশ থেকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলী চালায়। শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারা এই হত্যাকা-ে জড়িত তাদের সবার বিচার চাই।

জবানবন্দিতে আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, গোপালগঞ্জের বাসিন্দারাই সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথার সুযোগ বেশি পেয়েছে। কোটার কারণে মেধাবীদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এই সুবিধা নিতে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়।

আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ২০১৩ সালে কোটা আন্দোলনের সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম। আন্দোলনের একপর্যায়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ছাত্রলীগও আমাদের মিছিলের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের আন্দোলন আর অগ্রসর হয়নি।

জবানবন্দিতে জুনায়েদ আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে “সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ”-এর ব্যানারে কোটা সংস্কারের আন্দোলন পুনরায় শুরু হয়। এই আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন হাসান আল মামুন, নুরুল হক নূর ও রাশেদ খান প্রমুখ। আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়ে রাগের বশবর্তী হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সরকারি চাকরির নবম গ্রেড থেকে ১৩তম গ্রেডে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেন। ২০১৩ সালে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিদের জন্য ৩০ শতাংশ, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও এক শতাংশ কোটা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারণ করে। ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করলে দেখা যায় যে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য পাশ মার্ক ৭২, অন্যদিকে কোটাধারীদের জন্য তা হয় ৪২।’

প্রসিকিউশনের এই সাক্ষী বলেন, কোটা প্রথা বাতিল করে জারি করা প্রজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংসদ’-এর পক্ষ থেকে ওহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট বিভাগ উক্ত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করেন। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। পরে সেই আন্দোলন সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে।