রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে আগামী ১ জুন রায় ঘোষণা করবেন আপিল বিভাগ।

গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য এদিন ধার্য করেন।

আদালতে জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক। তাকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন ও ব্যারিস্টার আরমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট এস এম কামাল উদ্দিনসহ শতাধিক আইনজীবী।

আদালত কক্ষে জামায়াত নেতাদের পক্ষে দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির মো. সেলিম উদ্দিন, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, সহকারী সেক্রেটারী কামাল হোসাইনসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

পরে শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। সকল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এবং সংসদীয় রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী এই দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে কয়টা সঠিকভাবে সংসদ নির্বাচন হয়েছে সব নির্বাচনেই জামায়াতে ইসলামী জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছে। এমনকি সরকারেও অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো ২০০৮ সালে জামায়াতকে ইলেকশন কমিশন একটি নিবন্ধন ইস্যু করেন কিন্তু বাংলাদেশের হাইকোর্ট মেজরিটির জাজমেন্টের ভিত্তিতে এই নিবন্ধনটি বাতিল করেন। এর বিরুদ্ধে আমরা আপিল করেছিলাম। আপিল মামলার শুনানী শেষ হয়েছে। শুনানী অন্তে আগামী পহেলা জুন ২০২৫ এই মামলার রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আজ (বুধবার) আদালতে মূলত আমরা বলেছি যে, জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া বাতিল করার মাধ্যমে এবং কেয়ারটেকার সরকার সিস্টেম বাতিল করার মাধ্যমে পলিটিসাইজেশন অব জুডিশিয়ারি করা হয়েছে। অর্থাৎ বিচার বিভাগকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। যারা জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন মামলা শুনানী অন্তে নিবন্ধন বাতিল করেছেন তারা মূলত বাংলাদেশের উচ্চ আদালতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন এবং এ জন্যই নিবন্ধনটি বাতিল করা হয়েছে। আমাদের এই আর্গুমেন্ট আদালত অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করব যে, আমাদের এই আর্গুমেন্টের ভিত্তিতে আগামী পহেলা জুন, ইনশাআল্লাহ, জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফেরত পাবে। একই সাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী নতুন উদ্যমে নতুনভাবে মানুষের সাপোর্ট নিয়ে মেজরিটির ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, ইনশাআল্লাহ।

প্রতীক ফিরে পাওয়ার বিষয়ে কী বলেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় একটা একটা রেজুলেউশন আছে। এই রেজুলেউশনের কারণে ইলেকশন কমিশন একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা আদালতের কাছে এ বিষয়ে একটি ডাইরেকশন চেয়েছি। প্রতীক তো আর উচ্চ আদালত বরাদ্দ করতে পারে না। প্রতীক বরাদ্দ করার ক্ষমতা হল ইলেকশন কমিশনের। মাননীয় আদালত যেন এই মর্মে একটি অবজারভেশন দেন যে, এই ব্যাপারটি যেন ইলেকশন কমিশন উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেন। এই মর্মে আমরা ডাইরেকশন চেয়েছি। আমরা আশা করি পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই মর্মে ডাইরেকশনও উচ্চ আদালত কর্তৃক দেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেনন, দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ব্যবহার করছে অনেক আগ থেকে। আর আমাদের সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক আসছে ১৯৭২ সাল থেকে। বাংলাদেশে যত সংসদীয় ইলেকশন হয়েছে সব নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। ইলেক্টেড হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে। ফলে জামায়াতে ইসলামীর সাথে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ শুধু রাজনৈতিক দল দেখে না সাথে সাথে রাজনৈতিক সিম্বলটাও দেখে, প্রতীকটাও দেখে। সেজন্য আমরা বলছি যে শুধুমাত্র তার সঙ্গে ইলেকশন কমিশন যেন আমাদেরকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি বরাদ্দ করে এই মর্মে উচ্চ আদালত থেকে আমরা অবজারভেশন চাই লিখিত আকারে। আমরা অবজারভেশন চেয়েছি।

তিনি আরো বলেন, ফুল কোর্টের রেজুলেশন একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রশাসনিকভাবে নেয়া হয়। আর আজকে আমরা আদালতের কাছে অবজারভেশন চেয়েছি। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ আদালত। সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে এই মর্মে অবজারভেশন দিতে আইনগত কোন বাধা আমরা দেখি না। আমরা এটাও বলেছি যে, এখানে বাংলাদেশের সংবিধানের একটা অনুচ্ছেদ আছে। ১০৪ যাকে বলে কমপ্লিট জাস্টিস। এই কমপ্লিট জাস্টিসের থিওরি এপ্লাই করেও মাননীয় আপিল বিভাগ এই আদেশ দিতে পারেন। তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, আশা করি পহেলা জুন ইনশআল্লাহ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পাবেন। আমরা এটাও প্রত্যাশা করি আমাদের উচ্চ আদালত এরকম অবজারভেশন দিবেন যে অবজারভেশনের কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ দিবেন এটা আমরা প্রত্যাশা করি।

এর আগে মঙ্গলবার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে আপিলের তৃতীয় দিনের শুনানি শেষ হয়। পরে শুনানির জন্য বুধবার দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।

গত ১২ মার্চ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে আপিল শুনানি শুরু হয়।

গত বছরের ২২ অক্টোবর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ। এর ফলে নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে জামায়াতের আইনি লড়াই করার পথ খুলল যায়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

গত ১ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আবেদনের শুনানির জন্য এদিন ধার্য করা হয়।

আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত এ দিন ধার্য করেন। এর আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খারিজ হওয়া আপিলটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াতে ইসলামী। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় গত বছরের নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল খারিজের আদেশ দেন। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল থাকে।