জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আইনজীবীদের অধিকাংশই লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় বিচারাধীন মামলা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে দুর্নীতি বিরোধী রাষ্ট্রীয় একমাত্র সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নি¤œ আদালত পর্যন্ত দুদকের পক্ষে দায়ের করা মামলার দেখভাল করতেন এসব আইনজীবীরা। আইনজীবীদের অনুপস্থিতে আদালতে মামলা পরিচালনা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে দুদক। অবশ্য, অনুপস্থিত আইনজীবীদের শূন্যতা পূরণে নতুন আইনজীবী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুদক। এজন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, দুদক’র সাত হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩৩১টি মামলা সুপ্রিম কোর্টে। আর ঢাকাসহ দেশের নি¤œ আদালতে বিচার চলছে ২ হাজার ৮৩০টি মামলার। বছরের পর বছর মামলাগুলো ঝুলে থাকায় আসামীরা সুবিধা পাচ্ছেন। তারিখের পর তারিখ পেছানোর প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে অভিযুক্ত সরকারি চাকরিজীবীদের কেউ কেউ অবসরে যাওয়ার পর মামলা সচল করতে উদ্যোগী হন। তবে সম্প্রতি মামলাগুলো সচল করতে প্রস্তুতি নিয়েছে দুদক।
জানতে চাইলে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টি দুদকের একার পক্ষে সমাধানযোগ্য নয়। তার পরও মামলার সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে দুদক সব সময় সচেষ্ট। ৫ আগস্টের পর দুদকের কিছু আইনজীবী যোগাযোগ বন্ধ করেছেন। তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন করে আইনজীবী নিয়োগ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, আগামীতে মামলা পরিচালনায় দুদকের পক্ষ থেকে কোনো রকম সমস্যা থাকবে না।’
জানা গেছে, বিভিন্ন আদালতে দুদকের মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকাসহ নানা কারণে দুর্নীতিতে জড়িতদের আশানুরূপ সাজা হচ্ছে না। সময়মতো সাক্ষী, প্রমাণ ও কিছু আইনজীবীর আন্তরিকতার অভাবে সহসাই মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। পুরোনো কয়েক হাজার মামলা বিচারাধীন থাকতেই নতুন মামলা যুক্ত হচ্ছে। ফলে প্রতিবছরই দুদকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে দুদকের অন্তত ৪ হাজার ৩৩১টি মামলা বিচারাধীন আছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে ৩ হাজার ৭২৬টি এবং আপিল বিভাগে আছে ৬০৫টি। ঢাকাসহ দেশের নি¤œ আদালতগুলোতে মামলা রয়েছে ৩ হাজার ৪০৭টি। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের ৩ হাজার ৬৬টি এবং বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো আমলের মামলা ৩৪১ টি। অবশ্য হাইকোর্টের আদেশে ২৩৬টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। ফলে নি¤œ আদালতে ২ হাজার ৮৩০টির বিচার চলছে। এর আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৭৯টি। এর মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে ৩ হাজার ৭০১টি ও আপিল বিভাগে ৫৭৮টি। ঢাকাসহ নি¤œ আদালতে মামলা ছিল ৩ হাজার ৪১০টি। এর মধ্যে দুদকের মামলা ছিল ৩ হাজার ৬৬টি। প্রকৃত অর্থে গত এক বছরে বিচারাধীন দুদকের মামলার সংখ্যা মোটেও কমেনি। ব্যুরো আমলের মামলা কমেছে মাত্র তিনটি। একইভাবে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে দুদকের মামলা ছিল ৪ হাজার ৬৪১টি। এর মধ্যে হাইকোর্টে ৪ হাজার ১৮টি ও আপিল বিভাগে ৬২৩টি। ঢাকাসহ নি¤œ আদালতে মোট মামলা ছিল ৩ হাজার ৩৫৩টি। ওই সময়ে হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত ছিল ৪২৬টি। অর্থাৎ বিচার চলমান ছিল ২ হাজার ৯২৭টি মামলার।
সার্বিকভাবে প্রতিবছর দুদক যে হারে মামলা করে, সেই হারে নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুদকের মামলায় মোট নিষ্পত্তির হার মাত্র ১ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৪ সালে মোট নিষ্পত্তির হার ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে মোট নিষ্পত্তির হার ছিল ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
আইনজীবীদের অধিকাংশ লাপাত্তা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্যানেল আইনজীবীদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ পালিয়েছেন। এর ফলে দুদকের মামলা পরিচালনায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে আইনজীবী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংস্থাটি। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে আইনজীবী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে অনেকেই আবেদন করেছেন। এখন চলছে তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে নিয়োগ চূড়ান্তকরন প্রক্রিয়া। তবে, যারা সক্রিয় আছেন তাদের নিয়োগ বহাল থাকতে পারে। শুধুমাত্র যারা দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছেন তাদের বাদ দিয়ে নতুন নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, দুদকের সাংগাঠনিক কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) অনুযায়ী লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন অনুবিভাগের প্রধান মহাপরিচালকের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য ৫৬ জন প্যানেল আইনজীবী অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আছেন। যারা রিট, ফৌজদারি বিবিধ, ফৌজদারি আপিল এবং ফৌজদারি রিভিশন মামলাসমূহ পরিচালনা করেন। একইভাবে ঢাকায় ১৩টি স্পেশাল জজ আদালতে ১৪ জন প্রসিকিউটর বা প্যানেল আইনজীবী আছেন। ঢাকার বাইরে ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের অধীনে ৬৪টি জেলায় মামলার সংখ্যানুযায়ী প্রসিকিউটর বা প্যানেল আইনজীবী আছেন। কিন্তু, গত বছর ৫ আগস্টের পর সুপ্রিম কোর্টসহ বিভিন্ন আদালতে দুদকের আইনজীবীরা অনুপস্থিত থাকায় বিপাকে পড়ে কমিশন। অনেক আইনজীবী কোনো নোটিশ ছাড়াই দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। ফলে, কমিশন বিকল্প ভাবতে থাকে এবং গত জানুয়ারি মাসে কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নতুন করে আইনজীবী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন করে আইনজীবী নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়।