প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ইতিহাসে এটাই প্রথম যাতে রাজনৈতিক দলের (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর) রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে।

জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পেতে করা আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে আজ বুধবার আবার শুনানী করা হবে বলে আদেশ দেন।

আদালতে জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেছেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক। তাকে সহযোগিতা করছেন ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন প্রমুখ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলালসহ শতাধিক আইনজীবী। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।

আদালতে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, ঢাকা মহানগরী দক্ষিন জামায়াতের নায়েবে আমীর এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিনসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

পরে এডভোকেট শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি একটি ইনসেপারেবল টুইন। দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশের নাগরিকরা জামায়াতে ইসলামীর প্রতি অনেক আশা এবং আকাক্সক্ষা করে।

তিনি বলেন, ডেমোক্রেটিক প্রসেসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক যে নিবন্ধন ছিল ইলেকশন কমিশনে, সেটি গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্যানসেল করা হয় নাই। তড়িঘড়ি করে ইলেকশন কমিশনের সামনে দরখাস্ত পেন্ডিং থাকা অবস্থায় আদালত মেজরিটির ভিত্তিতে এই রেজিস্ট্রেশনটাকে ক্যানসেল করেছে। এর বিরুদ্ধে আমরা আপিল করেছিলাম। আপিল মামলার শুনানী হয়েছে। আগামীকালকে (বুধবার) আবার শুনানী হবে।

তিনি আরো বলেন, শুনানীতে মূল কথাটা যেটি এসেছে তার প্রথম ছিল যে প্রক্রিয়ায় আমাদের হাইকোর্ট বিভাগ এই নিবন্ধন ক্যানসেল করেছে, বাতিল করেছে এই প্রক্রিয়াটি মূলত ইলেকশন কমিশনের সামনে বিচারাধীন ছিল বিবেচনাধীন ছিল। ইলেকশন কমিশনের সামনে বিবেচনাধীন কোন বিষয় আদালত এইভাবে ক্যানসেল করতে পারে না। এটিকে ইংরেজিতে বলে প্রিম্যাচিওর। আর সেকেন্ড কথা হলো যারাই রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন। তাদের কোন লোকাসস্ট্যান্ডই নাই। তারা নিজেরাই পক্ষ দোষে দুষ্ট। তারা নিজেরাই ইলম মোটিভ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই এই মামলা দায়ের করেছিলেন। আর সর্বশেষ আমরা বলেছি যে, গণতন্ত্রে এইভাবে জামায়াতে ইসলামীর মত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়ে মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি করা হয়েছিল। যা ডেমোক্রেটিক প্রসেসকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই আর্গুমেন্টগুলোর ভিত্তিতে আমাদের আপিল বিভাগ আপিলের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত উপনীত হবেন বলে আমরা আশা করি এবং আগামীকালকে (বুধবার) বাকি অংশ শুনানী হবে।

প্রতীকের প্রশ্নে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ছিল আপনারা সবাই জানেন। আজ থেকে না জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দাঁড়িপাল্লা প্রতীক জামায়াতে ইসলামীর মার্কা হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের সকল সংসদীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়েই অংশগ্রহণ করেছে এবং সবসময় সংসদে আসন সংখ্যা নিশ্চিত করে সরকারেও অংশগ্রহণ করেছে এই দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৬ সালে ফুলকোর্ট সভার একটা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এই দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। আমরা সেটিও আদালতে তুলেছিলাম আজকে (মঙ্গলবার) সেটির উপরে আংশিক শুনানী হয়েছে। এই প্রতীক সংক্রান্ত বিষয়ে আগামীকালকে (বুধবার) সকাল ৯য়টায় এক নম্বর আইটেম হিসেবে শুনানী হবে। এরই মধ্যে আমরা চিন্তাভাবনা করে আদালতের সামনে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করব।

প্রধান বিচারপতি নিবন্ধন বাতিলের রায় প্রসঙ্গে কী বলতে চেয়েছেন? এ প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, উনি বলতে চেয়েছেন যে, এটাই প্রথম কোন ইনস্ট্যান্স কিনা, উদাহরণ কিনা যেখানে আদালত কর্তৃক রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়। আমরা বলেছি আদালত কর্তৃক রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নজির এই ভারতীয় উপমহাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই, এইটি প্রথম এবং জামায়াতে ইসলামীর রেজিস্ট্রেশনকে বাতিল করা হয়েছে, ইলেকশন কমিশন বাতিল করেনি, ইলেকশন কমিশন রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে কিন্তু হাইকোর্ট ডিভিশন মেজরিটির ভিত্তিতে এটি বাতিল করেছে এই নজির এই ভারতীয় উপমহাদেশে একটি এবং একমাত্র নজীর।

তিনি আরো বলেন, যখন এই মামলাটি জনাব জসিমউদ্দিন সরকার জামায়াতের পক্ষ থেকে কাগজপত্র ইলেকশন কমিশনে জমা দিচ্ছিলেন ইলেকশন কমিশন সংশোধনী দিয়েছিল আবার জমা দিয়েছেন আবার সংশোধনী দিয়েছে আবার জমা দিয়েছেন আবার সংশোধনী দিয়েছে ২০১২ সালের পহেলা অক্টোবর পর্যন্ত এই চিঠি আনা নেওয়া চলেছে জনাব জসিমুদ্দিন সরকার বারবার জমা দিয়েছেন। হাইকোর্টকে মাইনরিটি জাজ বলেছেন এইভাবে যখন একটি প্রক্রিয়া কোন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সামনে চলমান থাকে আর এই চলমান অবস্থায় হাইকোর্ট বিভাগ যখন এটিকে বাতিল করে তখন এটি মূলত প্রিম্যাচিওর অর্থাৎ ঘোড়ার আগেই গাড়ি জুড়ে দেয়া হয়েছে।

ইসি কী বলেছেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ইলেকশন কমিশন স্বীকার করেছেন যে, যখন এই বিষয়টি আমাদের বিবেচনাধীন ছিল জামায়াতে ইসলামী তার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ইলেকশন কমিশনে জমা দিয়েছিল, সেই সময় আমরা বিবেচনা করছিলাম কিন্তু যেহেতু হাইকোর্ট বিভাগে মামলাটি উত্থাপন হয়েছে এবং শুনানী শুরু হয়েছে সেইজন্য আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আর অগ্রসর হই নাই। এটি ইসি তার লিখিত বক্তব্যে স্বীকার করেছেন। আজকেও মৌখিক বক্তব্য আদালতকে বলেছেন যে, আমরা অগ্রসর হতে পারিনি কারণ আদালত এখানে হস্তক্ষেপ করেছে।

একজন ইন্টারভিনারের আবেদনের বিষয়ে তিনি জানান, এই মামলায় একজন ইন্টারভেনার দরখাস্ত করেছেন, তিনি দরখাস্ত করে তার সাবমিশন রাখতে চেয়েছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে উনারা মনে করছেন এখানে আর বাড়তি সাবমিশনের প্রয়োজন নাই তারপরেও দরখাস্তটি আগামীকালকে (বুধবার) নিষ্পত্তি করবেন। আমাদের এই দরখাস্ত সিম্বল এবং উনার ইন্টারভেনারের দরখাস্ত দুটো বিষয়েই আগামীকালকে (বুধবার) প্রথমার্ধে এক নম্বর আইটেম হিসেবে শুনানী হবে।

১০৪ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, ১০৪ এর ব্যাপারে এইভাবে এপ্লাই করা যায় কিনা এই ব্যাপারে আমাদের আইনগত সাবমিশন কি সেটাও তুলে ধরা। আমরা আইন কানুন দেখব। আরো ডিসিশন নিব। তারপরে আদালতে উপস্থাপন করব।

এর আগে এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াতে ইসলামী। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় ২০২৩ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল আবেদনটি খারিজের আদেশ দেন। যার ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল থাকে।

‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ হিসেবে খারিজ হওয়া আপিলটি পুনরুজ্জীবিত (রিস্টোর) করার আবেদন গত ২২ অক্টোবর শুনানি নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।