# হত্যার পর লাশের পেট ফেড়ে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো
আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম ও শতাধিক মানুষকে হত্যার মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে এ সংক্রান্ত আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। প্রসিকিশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে।
এর আগে সকালে ও শতাধিক হত্যাকা-ের ঘটনায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে এই অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর শাইখ মাহদী। জিয়াউল আহসান গতকাল ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গাজীপুরে পাঁচ জনকে হত্যা ছাড়াও বরগুনার পাথরঘাটার চর-দুয়ানিতে ৫০ জনকে হত্যা, বনদস্যু দমনের নামে সুন্দরবনে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যার তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে।
এছাড়াও জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, সাজেদুল হক সুমন, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ তিনশতাধিক ব্যক্তিকে গুম ও হত্যার সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
অভিযোগ আমলে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী ২১ ডিসেম্বর এ মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
গত ২৬ অক্টোবর এ মামলায় জিয়াউল আহসানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়ানো হয়।
এ মামলার ১১ আসামীর মধ্যে চার আসামীর নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও জিয়াউল আহসান।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে গতকাল শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর জানান, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুমের পর হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন জিয়াউল আহসান। এছাড়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী আলমসহ অন্যান্য গুমের বিষয়েও তিনি জড়িত রয়েছেন। এসব তদন্ত এখনও চলমান। এছাড়া শত শত মানুষকে গুমের পর হত্যা করেছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে আরও তিন থেকে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যার তদন্ত চলছে।
এ মামলায় জিয়াউলের বিরুদ্ধে মোট তিনটি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ভিন্নমত দমনে গুম-খুনের সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। তার গুম-খুনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের মহানায়ক ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান।
তিনি বলেন, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনায় আসামী জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে একটি ফরমাল চার্জ দাখিল করেছি। তার বিরুদ্ধে তিনটি প্রধান অভিযোগ আনা হয়েছে। এই তিনটি ঘটনায় ১০০-এর বেশি মানুষকে গুম করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশের পেট ফেড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে কখনো বরগুনার বলেশ্বর নদীতে, কখনো সুন্দরবনে, কখনো শীতলক্ষ্যায়, আবার কখনো বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দেওয়া হতো।”
তাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম অভিযোগ হলোÑ রাতের বেলায় গাজীপুরের র্যাব অফিস থেকে পাঁচজনকে টঙ্গীর নির্জন রাস্তায় নিয়ে চোখ ও হাত-পা বেঁধে মাথায় গুলী করে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ ড্রেনে বা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা এসব হত্যাকা-ের অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি।
দ্বিতীয় অভিযোগে তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম করে মাইক্রোবাস, জিপ বা বিভিন্ন গাড়িতে চোখ ও হাত-পা বেঁধে বরগুনার চরদুয়ানি ঘাটে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর ‘অপারেশন’-এর কথা বলে রাতের বেলা চরদুয়ানি বাজারসহ আশেপাশের দোকানদারদের রাত ৯টার মধ্যে দোকান বন্ধ করে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতো। আলো নিভিয়ে ওই এলাকায় ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হতো। এরপর ভিকটিমদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে করে বলেশ্বর নদী হয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে মাথায় বালিশ ঠেকিয়ে গুলী করে হত্যার পর লাশের পেট ফেঁড়ে সিমেন্টের বস্তা বা ইট বেঁধে ফেলে দেওয়া হতো। এভাবে ৫০ জনকে হত্যার অভিযোগে আমরা চার্জ দাখিল করেছি।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, একই পদ্ধতিতে একই জায়গায় আরও প্রায় ৩০০ মানুষকে হত্যার তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।
তৃতীয় অভিযোগে তাজুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে বনদস্যু দমনের নামে নিশানখালী, কটকা ও মরাভোলাÑ এই তিনটি পয়েন্টে অপারেশন চালানো হয়। এই অপারেশনগুলোতে তারা অনুগত সাংবাদিক ও হেলিকপ্টার নিয়ে যেত। প্রচার করা হতো যে, অপারেশন চালিয়ে বনদস্যু হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু অপারেশনের আড়ালে তারা আসলে গুম করে রাখা মানুষদের সেখানে নিয়ে যেত। দুই-একজন বনদস্যুর সঙ্গে গুম হওয়া ব্যক্তিদের একই কায়দায় বুকে বালিশ ঠেকিয়ে গুলী করে হত্যা করা হতো। এরপর পেট ফেঁড়ে সিমেন্টের বস্তা ও ইট বেঁধে লাশ নদীতে ফেলে দিয়ে সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রচার করা হতো যে, বনদস্যু মারা হয়েছে।
তাজুল ইসলাম জানান, আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামীর বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেছে। পরবর্তী শুনানির জন্য ২১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। এদিন জিয়াউল আহসানকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।