রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে দোকানে ঢুকে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার ঘটনায় বেশ কিছু দিক খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসছে ফের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশন। এ ঘটনায় কিলার জনিকে গ্রেফতারের পর কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া অপর দুই খুনি পাতা সোহেল ও দর্জি মাসুম ওরফে ভাগ্নে মামুনের নাম সামনে এসেছে। নির্দেশদাতার তালিকায় রয়েছে মিরপুরের ফোরস্টার গ্রুপের দুই ভাই মশিউর ও মামুন। তারা পুলিশের খাতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী। দুবাই বসেই হত্যার নির্দেশ দেয় মামুন। আর তা বাস্তবায়ন করে মামুনেরই ছোট ভাই মশিউরের ক্যাডার হিসাবে পরিচিত জনি, পাতা সোহেল ও দর্জি মাসুম। মূলত মিরপুরের সবুজবাংলা ও বাউনিয়াবাধ এলাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সদস্যদের চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় কিবরিয়াকে খুন করা হয় বলে তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, খুনিদের শনাক্ত করা গেছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। এরইমধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকী দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে বলে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবী। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষন করে খুনিদের সম্পর্কে একটি ধারনা পাওয়া গেছে। তারা পরিচয় আড়াল করতে হেলমেট ব্যবহার করলেও নিজেদের আড়াল করতে পারেনি। এখন খুনিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হলে এর নেপথ্যে কারা আছে তা বেরিয়ে আসবে। তবে এর পেছনেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে পল্লবীর একটি দোকানে প্রবেশ করলে হেলমেট পরা তিন যুবক অপর দরজা দিয়ে ঢুকে কিবরিয়াকে এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মারা যান বলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান।

জানা গেছে, চলতি মাসের ১০ তারিখে রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে হত্যার রেশ না কাটতেই এবার মিরপুরে দোকানে ঢুকে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার ফুটেজ ভাইরাল হওয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নিহত কিবরিয়া পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব ছিলেন। এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন বলে স্থানিয়রা দাবী করেন। চাঁদাবাজীর বিরুদ্ধে সব সময় ছিলেন সোচ্চার। সম্প্রতি মিরপুরের সবুজবাংলা ও বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়িদের কাছে বেপরোয়া চাঁদাবাজী করে আসছিলো মিরপুরের ফোরস্টার গ্রুপের সদস্য হিসাবে পরিচিত মামুন ও মশিউর। তারা সম্পর্কে আপন দুই ভাই। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তাদের পরিচিতি বেড়ে গেলে পুলিশ গ্রেপ্তারে তৎপর হয়। বিষয়টি টের পেয়ে দেশ ছেড়ে দুবাই চলে যায় এই দুই ভাই। সেখানে বসেই চাাঁদাবাজি করে আসছিলো। সম্প্রতি তাদের চাঁদাবাজীতে বাধা হয়ে দাঁড়ান নিহত যুবদল নেতা কিবরিয়া। এছাড়াও সম্প্রতি পল্লবী এলাকায় একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গুলি করে চাঁদা দাবীর একটি ফুটেজ ভাইরাল হলে সেখানেও মামুনের ক্যাডারদের শনাক্ত করতে পুলিশকে সহায়তা করেন কিবরিয়া। এ নিয়েও কিবরিয়ার উপর ক্ষিপ্ত ছিলো মামুন ও মশিউর। সম্প্রিত কিবরিয়াকে সরিয়ে দিতে ক্যাডারদের জড়ো করে মশিউর। এরপর কিবরিয়ার চলাফেরা নরজাদারী করার পর তারা নিশ্চিত হন, প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে পল্লবীর সেকশন-১২, ব্লক-সি এলাকায় বন্ধুর দোকানে আড্ডা দেন কিবরিয়া। এরপর সোমবার সন্ধ্যার দিকে কিবিরিয়া ওই দোকানে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই তিন খুনি সেখানে উপস্থিত হয়ে উপর্যপুরি গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে বেরিয়ে যায়। মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই তারা মিশন শেষ করে একজন বাইক নিয়ে দ্রুত চলে যায়। ব্কাী দুইজন একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠলে জনতা ধাওয়া করে। এসময় দ্রুত রিকশা না চালানোর কারনে আরিফ নামে ওই চালককেও গুলি করা হয়। আহত অবস্থায় আরিফ এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধিন। পরে স্থানিয়রা জনিকে ধাওয়া দিয়ে আটক করে পুলিশে দেয়। তবে তার কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরপর জনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসে খুনের আদ্যপান্ত।

পুলিশ জানায়, হেলমেট মাথায় চাদর গায়ে যাকে গুলি করতে দেখা যাচ্ছে তার নাম দর্জি মাসুম। নীল শার্ট পরিহিত প্রথম যে ব্যাক্তি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দোকানে প্রবেশ করছে তার নাম পাতা সোহেল। আর মিশনে অংশ নেওয়া চেক শার্ট পড়া ব্যাক্তির নাম জনি। এই জনি এখন পুলিশের হাতে গ্রেফতার।

স্থানিয়রা দাবী করেন. নিহত কিবরিয়ার সঙ্গে একসময় ভালো সম্পর্ক ছিলো মামুনের। কিন্তু মামুনের সন্ত্রাসীমূলক কর্মকান্ডের কারনে তার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরইমাঝে ছোটভাই মশিউরকে নিয়ে দেশ ছাড়েন মামুন। কিন্তু দুবাই বসেই মামুন-মশিউরের হয়ে মিরপুরের সবুজবাংলা ও বাউনিয়াবাধ এলাকা নিয়ন্ত্রন করে আসছিলো কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া তিন কিলারসহ আরো অনেকে।

পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন, কিলার ইব্রাহিম, শাহাদাত ও সিন্ডিকেট মুক্তার এই চারজন মিলে গড়ে তুলেছে ফোর স্টার গ্রুপ। চারজনই বিদেশে বসে গোটা মিরপুরকে চার ভাগে ভাগ করে চালাচ্ছে তাদের অপরাধ সাম্রাজ্য। এর মধ্যে মামুনের নিয়ন্ত্রণে মিরপুর ১২, পল্লবী, বাউনিয়া ও সাগুফতা, ইব্রাহিমের নিয়ন্ত্রণে, মিরপুর ১৩, ১৪, ভাসানটেক ও কালশী, শাহাদাতের নিয়ন্ত্রণে মিরপুর ১, ২, ৬ ও ৭, সর্বশেষ মুক্তারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মিরপর ১০ ও ১১। এসব এলাকার চাঁদাবাজি, মাদক কারবার থেকে শুরু করে হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। যদিও এসব নিয়ে ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চায়না। ফোর স্টার এই গ্রুপের গডফাদাররা বিদেশে থাকলেও দেশের মাটিতে তাদের কর্মকা- চালাচ্ছে অন্তত শতাধিক ক্যাডার। এর মধ্যে মামুন বাহিনীর হয়ে দেশের মাটিতে তার অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে তারই বড় ভাই জামিল, ছোট ভাই মশিউর (দুবাই), রফিকুল, শহিদুল, নাটা আলমগীর, কালা মোতালেব, দেলোয়ার হোসেন রুবেল, রাজন, সানি, ভাগ্নে মামুন ওরফে মাসুম, সোহেল, কায়েস। কিলার ইব্রাহিমের হয়ে কাজ করছে, যুবরাজ, সাবু, শাকিল, ভাগ্নে সোহেল, কালা ইব্রাহিম, জনি। শাহাদাতের হয়ে টিপু সুমন, ফিটিং শিশির, বিহারি নিলা, প্রচার সাইফুল, পিচ্চি আলামিন, শামিম। মুক্তারের হয়ে তার সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে, হাড্ডি সোহাগ, নওশাদ, আশিক, ডাসা শরিফ, এলেক্স জুয়েল, শুটার জাকির, তপু, আমিন, রকি, ছোট রাকিব, শাহাপরান, মিঠু, আতিকসহ আরো অনেকে। সম্প্রতি মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার চাঁদাবাজীতে বাধা দেওয়ার কারনে এই মামুনের নির্দেশে খুন করা হয় কিবরিয়াকে।

কিবরিয়ার শরীরে গুলির ১৮ চিহ্ন, পাওয়া গেল দুটি : গোলাম কিবরিয়ার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তার চোয়াল, গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৮টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্তের সময় শরীরের ভেতর দুটি গুলি পাওয়া গেছে। বাকিগুলো শরীরে ঢুকে অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মর্গের একটি বিশ্বস্ত সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কিবরিয়ার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান এ ময়নাতদন্ত পরিচালনা করেন। গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, পূর্ব পরিচিতদের দ্বন্ধ থেকেই এই হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে।

মর্গের একটি সূত্র জানায়, ময়নাতদন্তে নিহতের চোয়াল, গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৮টি চিহ্ন দেখা গেছে। অর্থাৎ গুলি শরীরে প্রবেশ ও প্রস্থানের ফলে মোট ১৮টি চিহ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে শরীরের ভেতর থেকে দুটি গুলি পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর ১২টার দিকে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, হত্যাকা-ের কিছু আগে গোলাম কিবরিয়া একটি দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই অপর দরজা দিয়ে হেলমেট পরা তিন যুবক ঢুকে খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাটি স্পষ্টতই পূর্ব পরিকল্পিত। তিনি আরও বলেন, নিহতের পরিচিতদের মধ্যে কেউ এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। একই সঙ্গে জনপ্রিয়তা ও স্থানীয় প্রভাবসহ সব দিক বিবেচনা করে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে।

ময়নাতদন্তের আগে পল্লবী থানার এসআই মো. আনোয়ার হোসেন লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেখানে নিহতের চোয়ালসহ শরীরের বহু স্থানে গুলির চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

নিহত গোলাম কিবরিয়া (৪৮) মিরপুর ১২-এর রোড নম্বর ৩ এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার বাবার নাম মৃত মো. আলী তালুকদার।

১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। আসামিরা হলেন, মো. জনি ভূঁইয়া (২৫), সোহেল ওরফে পাতা সোহেল ওরফে মনির হোসেন (৩০), সোহাগ ওরফে কাল্লু (২৭), মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম (২৮) ও রোকন (৩০)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৭/৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার নিহতের স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিন পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, হত্যাকা-ের ঘটনায় একজন গ্রেফতার আছে। বাকিদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামি পাতা সোহেল ও আসামি মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তারা পূর্ব পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিলে আসামিদের মধ্যে এক নম্বর আসামি জনি ভূঁইয়া, সোহাগ ওরফে কালু ও রোকন ওই দোকানে অতর্কিতভাবে প্রবেশ করে। কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে পিস্তল দিয়ে চোয়ালে, গলার ডান পাশে, বাম কানের পেছনে, ঘাড়ের পেছনে, বুকের ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, ডান হাতের বাহু, বাম হাতের কুনই, বাম হাতের কব্জিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলির পর রক্তাক্ত অবস্থায় দোকানের ফ্লোরে পড়ে গেলে আসামিরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।