শেখ হাসিনা হত্যার পর লাশ গুমের নির্দেশ দিয়েছিলেন জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।

গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে দেওয়া জবানবন্দীতে তিনি এ বর্ণনা দেন। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৪৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দীর পর তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আজ বুধবার আবার মাহমুদুর রহমানকে অবশিষ্ট জেরা করা হবে।

জবানবন্দিতে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, জুলাই বিপ্লবের সময় চালানো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। ওই প্রতিবেদনের মতে এ গণহত্যা চালানোর জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এজন্য প্রতি রাতে নিজ বাসায় কোর কমিটির সভা করতেন কামাল। বৈঠকে পুলিশ-র‌্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নিতেন। সেখানেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রদের ওপরে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের উপায় নিয়ে আলোচনা করতেন তারা। সেসব বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাতে তারা জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের ওপর যেন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এছাড়া প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমে আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশের ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এমনকি আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ গুমের নির্দেশ দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় পড়ে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বরাতে মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবে প্রায় ১৪০০ আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে প্রধানত জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে চলা ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার অবর্ণনীয় জুলুম নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নিয়মিত আলোচনার পাশাপাশি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রতিবছর প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট প্রতিবেদনেও শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা ও মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের বর্ণনা রয়েছে।

এ ছাড়া। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে হওয়া তিনটি ভুয়া নির্বাচনের কথাও প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিউম্যান রাইটস। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংসদেও এ তিনটি নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে বলেও জবানবন্দিতে বিবরণ দেন এই তারকা সাক্ষী।

ট্রাইব্যুনালে গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার, আব্দুস সাত্তার পালোয়ান, সহিদুল ইসলামসহ অন্যরা।

এর আগে, ১৫তম দিনের মতো ১৫ সেপ্টেম্বর দিনভর সাক্ষ্য দেন মাহমুদুর রহমান। তার অবশিষ্ট সাক্ষ্য শেষে গতকাল জেরা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত মোট ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ রেকর্ড করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

জেরায় মাহমুদুর রহমান বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ-প্রশাসনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারও কোনো পদোন্নতি দেননি।

জেরার একপর্যায়ে এই সাক্ষীর উদ্দেশ্যে আমির হোসেন বলেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে ২০০৮ সালে ভূমিকা রাখায় তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী ও ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদরা পদোন্নতি পেয়েছেন বলে আপনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে তারা নিজ যোগ্যতায় বড় পদ পেয়েছেন। কোনো পুরস্কার হিসেবে নয়।

জবাবে সত্য নয় বলে জানান মাহমুদুর রহমান। ইহা সত্য নয় যে, শেখ হাসিনার আমলে তোষামোদির মাধ্যমে পদোন্নতির ঘটনা ঘটেনি। পরে সাক্ষী বলেন, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে কারো কোনো পদোন্নতি যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী পুলিশের ডিআইজি থেকে ওপরের সব পদে পদোন্নতির বিষয়ে নিজ সিদ্ধান্ত দিতেন শেখ হাসিনা।

এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, মাহমুদুর রহমান বলেছিলেন যে, পুলিশের ডিআইজি থেকে ওপরের পদোন্নতি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন শেখ হাসিনা। তিনি যাকে মনে করতেন তাকে ওই পদে পদোন্নতি দিতেন আর যাকে মনে করতেন না তাকে দিতেন না।