স্ট্রেচারে রক্তমাখা লাশ। শরীরজুড়ে ছররা গুলীর ক্ষত। আর মাথার পেছনে রক্তাক্ত চিহ্ন। এমন ভয়াবহ চিত্র নিজ চোখে দেখলেও সুরতহাল প্রতিবেদনে সত্য লুকানোর নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছিল, ছররা গুলীর আঘাত লেখা যাবে না। আপত্তি জানাতেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হুমকি দিয়ে বলতেন, কথা না শুনলে তোকে জামাত-শিবির বানিয়ে চালান করে দেব।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রংপুরের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় এমন সাক্ষ্য দেন এসআই মো. তরিকুল ইসলাম।
গতকাল মঙ্গলবার চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
তরিকুলের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায়। ৩৫ বছর বয়সী এই পুলিশ পরিদর্শক বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভাষানটেক থানায় কর্মরত রয়েছেন। তবে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানা এলাকা ও হাসপাতালে ইউডি (অপমৃত্যু) দায়িত্বে ছিলেন।
সাক্ষী তরিকুল বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছিল। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি লাশ রয়েছে বলে তাজহাট থানার বেতার বার্তার মাধ্যমে জানতে পারি। লাশটির সুরতহাল করতে হবে। ওই সময় আমার সঙ্গীয় কনস্টেবল লিটন দেবনাথসহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হই। পুলিশের গুলীতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একজন ছাত্র নিহত হয়েছেন বলে জেনেছি। তার নাম আবু সাঈদ। তখন মেডিকেল কলেজের ভেতরে অনেক উত্তেজনা বিরাজ করছিল। অনেক পুলিশ দায়িত্বরত ছিলেন।
তিনি বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসপাতালে আসেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান আরিফ। তিনি আমাকে বলেনÑ তুমি লাশ দেখেছো? জবাবে আমি বলি, না স্যার, আমি লাশ দেখিনি। এরপর তিনি বলেন, তুমি লাশ দেখে আসো। আমি লাশ দেখে এসে আরিফুজ্জামান স্যারকে বলিÑ লাশের শরীরে অসংখ্য ছররা গুলীর আঘাত রয়েছে। মাথার পেছনে ক্ষত চিহ্ন। সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে; যা স্ট্রেচারে রক্তমাখা অবস্থায় রয়েছে। এসব শুনে আরিফুজ্জামান স্যার আমাকে বলেন, সুরতহালে ছররা গুলীর আঘাতের কথা লেখা যাবে না। এ কথায় একমত পোষণ না করলে তিনি আমাকে গালিগালাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে বলেন, ব্যাটা তুই কথা শুনবি না? কথা না শুনলে তোকে জামাত-শিবির হিসেবে চালান করে দেব।
এসআই তরিকুল বলেন, ওই সময় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। এসি আরিফুজ্জামান স্যার আমাকে বলেন, আমার ওপর চাপ আছে, তোকে এটা করতেই হবে। আমি তার কথায় রাজি হইনি। তার কথামতো সুরতহাল প্রস্তুত করলে পরবর্তী সময়ে আমার সমস্যা হতে পারে বলে জানিয়ে দেই। তিনি এ কথা শুনে আরও রেগে গিয়ে আমার মৃত বাবা-মা তুলে গালিগালাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে বলেন, তোকে আওয়ামী লীগের লোক দিয়ে মেরে ফেলব। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই।
এই সাক্ষী আরও বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এসি আরিফুজ্জামান স্যার। পুনরায় আমাকে সুরতহাল প্রস্তুত করতে চাপ দেন তিনি। আমি উপায় না দেখে রংপুর মেট্রোপলিটনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতের উপস্থিতিতে আবু সাঈদের সুরতহাল প্রতিবেদনে ছররা গুলীর কথা বাদ দিয়ে দেই। একই সঙ্গে শরীরে অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষত চিহ্ন ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন লিখে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে বাধ্য হই। পরবর্তী সময়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া, মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে আমি আবু সাঈদের লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়ে দেই। মূলত ত্রুটিপূর্ণ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করতে আমাকে বাধ্য করা হয়েছে।
গতকাল বেলা ১১টার পর আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে চতুর্থ দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মঈনুল করিম।
গতকাল সকালেও এ মামলার ছয় আসামিকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন- এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। তবে বেরোবির ভিসিসহ এখনও ২৪ জন পলাতক রয়েছেন। তাদের পক্ষে সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, গ্রেপ্তার আসামীপক্ষের আইনজীবীরাও রয়েছেন।