রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে নিবন্ধন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
গতকাল রোববার দলটির পক্ষে করা আপিল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দিয়েছেন। এর ফলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকসহ নিবন্ধন পুর্নবহাল হলো। ইতোমধ্যে রায়ের সংক্ষিপ্ত কপি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে পৌছাঁনো হয়েছে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, জামায়াতে ইসলামীর ‘পেন্ডিং রেজিস্ট্রেশন’ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অন্যদিকে, দলীয় প্রতীক সংক্রান্ত জামায়াতের আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন কোনো পর্যবেক্ষণ না দিয়ে মঞ্জুর করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। নিবন্ধন নাম্বার ছিল ১৪, প্রতীক ছিল “দাড়িঁপাল্লা। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেন হাইকোর্টের বেঞ্চ। এ রায়কে গতকাল রোববার আপিল বিভাগ বাতিল করেছে। যার ফলে নির্বাচন কমিশনের ২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ সাময়িক নিবন্ধন পুর্নবহাল হলো। ইসির তালিকায় নিবন্ধন নাম্বার ১৪ এর কলাম এখনো ফাঁকা রয়েছে।
রায়ের পর জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আজকে (রোববার) দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার নিবন্ধন ফিরে পেলো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মামলার মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজকের এই রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক এবং অংশগ্রহণমূলক সংসদ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো।
তিনি বলেন, আমরা আশা করি এই রায়ের পর বাংলাদেশে সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই তাদের ইচ্ছানুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে বেছে নেবে এটা আমরা প্রত্যাশা করি। এবং আমরা এটাও প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশের আগামী সংসদে ইন্টারেস্টিং এবং কনস্ট্রাক্টিভ বিতর্ক হবে যার মাধ্যমে ডেমোক্রেসি একটি স্থায়ী রূপ লাভ করবে।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আজ (রোববার) আপিল বিভাগ হাইকোর্টের যে রায় ছিল সে রায়কে বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রেজিস্ট্রেশন এবং অন্য যেসব ইস্যু কমিশনের সামনে আসবে সেগুলো যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করে তারা। এর মাধ্যমে আজকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পেলো এবং প্রতীকের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের সামনে রেফার করা হলো ‘আদার ইস্যু’ হিসেবে। এজন্য আমরা মামলার শর্ট অর্ডার চেয়েছি। আমরা আশা করি আগামীকালের মধ্যেই মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ হাতে পাবো। এই আদেশ আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অ্যাপ্রোচ করবো এবং কমিশন অতিদ্রুত জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক বুঝিয়ে দেবেন- এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী মো. তৌহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ তা অবধ ও বাতিল করে দিয়েছেন। এর ফলে হাইকোর্টের রায়ের আগে যে অবস্থা ছিল এখন সেটা ফেরত এলো।
আদালতে জামায়াতের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকারসহ কয়েক শতাধিক আইনজীবী।
আদালতে জামায়াত নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, মোবারক হোসেন, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির মো. সেলিম উদ্দিনসহ অনেকে।
উল্লেখ্য, গত ১৪ মে এ মামলায় আপিল শুনানি শেষে রায়ের জন্য ১ জুন দিন ধার্য করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ওইদিন আদালতে জামায়াতের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
২০২৩ সালের ১৯ নবেম্বর জামায়াতের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে উপস্থিত না থাকায় আদালত আপিল মামলাটি খারিজ করে দেন। এরপর আপিলটি পুনরুজ্জীবনের জন্য আবেদন করা হয়। গত বছরের ২২ অক্টোবর আদালত বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য রিস্টোর করেছেন অর্থাৎ পুনরুজ্জীবন করেন।
এরপর ৩ ডিসেম্বর আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল। চতুর্থ দিনের মতো শুনানি শেষে মামলার রায়ের দিন ধার্য করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় রায় ঘোষণা করা হয় গতকাল।
২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন।
রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানান।
এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের (বর্তমানে অবসর) হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নবেম্বরে দু’বার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নবেম্বরে দু’বার তারা গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয় জামায়াত। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হয়। একই বছরের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নবেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। একই সঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দেন। তবে এ রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। ২০২৩ সালের ১৯ নবেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে গত বছর জুলাই মাস থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে ছাত্র-জনতা সরকার পতনের দাবি তোলে। এর মধ্যে ১ আগস্ট সরকার জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের আবেদন বাতিলের উদ্যোগ নেয়। গত ২৮ আগস্ট সরকার আগের নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে। এরপর আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করে।