নারীর প্রতি সহিংসতার কয়েকটি ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলেও এসব ঘটনায় জড়িতদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় আসামীদের গ্রেফতার এবং মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ধর্ষণের শিকার হয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে শহীদ কন্যা লামিয়ার আত্মহত্যার ঘটনায় আবারও আলোচনায় আসে ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের ঘটনা। এ ঘটনায় জড়িত দুই জনকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়-সম্প্রতি দেশের কয়েকটি স্থানে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আলোচিত হলেও এসব ঘটনায় তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধর্ষণের বিচার দ্রুততার সাথে শেষ করা এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

তারপরও ধর্ষণের ঘটনায় আইন হাতে তুলে নিয়ে মব সৃষ্টি করার ঘটনাও ঘটছে। গাজীপুরের পূবাইলের হায়দারাবাদ এলাকায় ধর্ষণের অভিযোগে রহিজ উদ্দিন (৩৫) নামে একজন ইমামকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পিটুনীতে আহত অবস্থায় রোববার রাত ৩টার দিকে গাজীপুর জেলা কারাগারে তার মৃত্যু হয়। ইমাম রহিজ উদ্দিন কুমিল্লার মতলব উপজেলার বাসিন্দা। তিনি গাজীপুর মহানগরীর হায়দারাবাদ আখলাদুল জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে কাজ করতেন।

এদিকে ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে অর্ধেক করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। কিছু দিন আগে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ধর্ষণের মামলায় তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর বিচার শেষ করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। এ ছাড়া উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন তবে ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়াই চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষীর ভিত্তিতে মামলার বিচারকাজ চালাতে পারবেন। এমন বিধান রেখে আইন সংশোধন করা হচ্ছে। উপদেষ্টা জানান, অধ্যাদেশের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন এমএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসে ১৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৭টি। মার্চে দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়েছিল ১৭টি, যেটি পরের মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫টিতে। ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছিল ১৯টি আর এ ধরনের ঘটনা মার্চে ঘটে ৬১টি। জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। তিনমাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২২৮টি। অন্য আরেকটি সংগঠনের প্রতিবেদনে গত বছরের (২০২৪) ধর্ষণনের ঘটনায় জানুয়ারিতে ৩০৮টি মামলা, ফেব্রুয়ারিতে ৩৫১টি মামলা ও মার্চ মাসে ৩৭৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ধর্ষণের ঘটনা কমেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ধর্ষণ মামলার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের ঘটনায় ২০২৩ সালে মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৯১টি। ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে চার হাজার ৩৯৪টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে নয় হাজার ৯৭৭টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদিকে, ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তিন বছরের জানুয়ারির মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে বেশি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫৪টি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৮টি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৯২টি মামলা হয়েছে।

মাগুরার মামলায় ৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ: মাগুরার আলোচিত আট বছরের সেই শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আরও তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। সোমবার সকালে মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসানের আদালতে দ্বিতীয় দিন শিশুটির চাচা, মাদরাসা শিক্ষক ও এক ছাত্র সাক্ষ্য দেন বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল। এর আগে সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আসামি হিটু শেখ, তার দুই ছেলে সজীব শেখ, রাতুল শেখ এবং স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে আদালতে আনা হয়। পিপি মুকুল বলেন, এ মামলার তিন থেকে পাঁচ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়েছে আদালত। সাক্ষীরা হলেন- শিশুটির চাচা মোহাম্মদ ইব্রাহিম, আসামি হিটু শেখের এলাকার বাসিন্দা নিজানান্দুয়ালী গ্রামে হযরত আলী ও মাদরাসা শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। মামলা ৩৭ জন সাক্ষী রয়েছে। এদিন আদালত মামলার আরও ১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছে বলে জানান তিনি। জেলার শ্রীপুর উপজেলার আট বছরের শিশুটি ১ মার্চ মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বড় বোনের বাড়ি বেড়াতে আসে। সেখানে সে ৬ মার্চ ধর্ষণের শিকার হয়। প্রথমে তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যার হাসপাতাল, পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠানো হয়। সবশেষ চিকিৎসারত অবস্থায় ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শিশুটি মারা যায়। এ ঘটনায় শিশুটির মা মাগুরা সদর থানায় মেয়ের শ্বশুর হিটু শেখ, জামাই সজীব শেখ, তার ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা রোকেয়া বেগমের নামে মামলা করেন। পুলিশ চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে। ১৩ এপ্রিল আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন।

বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার না করার অনুরোধ: পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় জুলাই আন্দোলনে শহীদ জসিম উদ্দিনের কন্যা লামিয়াকে নির্যাতনের মামলায় গ্রেফতার দুই আসামি বর্তমানে জেলহাজতে আটক রয়েছেন। এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর কোনো প্রচারণা না চালানোর জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন পটুয়াখালী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান টোটন। তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ আহ্বান জানান। স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘জুলাই আন্দোলনের শহীদ জসিম উদ্দিনের কন্যা লামিয়া নির্যাতনের মামলার ধৃত আসামিদ্বয় জেলহাজতে আটক আছে। এ বিষয়ে কাউকে কোনো রকম বিভ্রান্তিকর প্রচার প্রচারণা না করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে দুমকি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, লামিয়ার করা মামলায় এজাহারনামীয় দুই আসামি সাকিব মুন্সি এবং সিফাত মুন্সি দুজনই বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছে। তাদের জামিন হয়নি। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন মিডিয়ায় আসামিদ্বয়ের জামিন সংক্রান্ত যে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে তা সত্য নয়। অভিযুক্ত দুইজনই বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। জনসাধারণ ও গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে অনুরোধ জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার বা শেয়ার না করতে। অপপ্রচারে মামলার স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া বিঘিœত হয় এবং ভিকটিমের পরিবার যাতে নতুন করে মানসিক চাপের মুখে না পড়ে।

প্রেমিকসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন: বছর ছয়েক আগে ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায় এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় তার প্রেমিকসহ পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। সোমবার ঢাকার ২ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শাহাদত হোসেন এ আদেশ দেন। দ-িতরা হলেন- ইয়াসিন সরদার হৃদয়, তার বন্ধু ফাহাদ শেখ পিয়াল, দেলোয়ার হোসেন দেলু, সুজন ও উজ্জ্বল। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী হেলাল উদ্দিন বলেন, যাবজ্জীবন কারাদ-ের পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অর্থদ-, অনাদায়ে প্রত্যেককে পাঁচ বছর করে কারাদ- দেয়া হয়েছে।

মনিপুর স্কুলের সেই শিক্ষক বরখাস্ত : শিক্ষার্থীদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগে বিক্ষোভের মুখে রাজধানীর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল বালক (প্রভাতী) শাখার সিনিয়র শিক্ষক মো: খলিলুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সোমবার স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আখলাক আহম্মদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই বরখাস্তের কথা জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, আপনার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ, অভিভাবকবৃন্দের লিখিত অভিযোগ এবং শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্লাস বর্জন ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এডহক কমিটির সভাপতির নির্দেশক্রমে আপনাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে গত বছরের ১১ নবেম্বর খলিলুর রহমান নয়নকে শোকজ ও বাধ্যতামুলক ছুটিতে পাঠিয়েছিল স্কুল কমিটি। তখন তিনি মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখায় কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি মূল বালক শাখায় যোগদান করায় সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।