দেড় দশক আগে রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনকে সাক্ষ্য দিতে ডাকলেও তাতে সাড়া দেননি কেহই। কোন মাধ্যমেই তাঁদের কোন প্রকার সাড়া পায়নি কমিশন। গত ৮ মার্চ শনিবার তাদেরকে সাক্ষ্য প্রদানের আহবান জানিয়ে একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে কমিশন। বিজ্ঞপ্তিতে সাত দিনের মধ্যে কমিশনের ধানমন্ডি কার্যালয়ে হাজির হয়ে বা অনলাইনে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়।
এদিকে, কমিশনের কাছে বিডিআর হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে সহ¯্রাধিক ব্যক্তি এ যাবত স্বাক্ষ্য দিয়েছেন বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে। ওই সুত্রগুলোর দাবি, কমিশন আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে পারবে। এ সময় বেশ কিছু সুপারিশও সরকারকে কমিশন দেবে। স্বাধীন তদন্ত কমিশনটি প্রথমে তিন মাসের জন্য গঠিত হলেও পরে এর মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে বিডিআর সদর দফতরে বিদ্রোহ ও হত্যাকা- তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে ৯০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এই কমিশনের সদস্য সংখ্যা একজন সভাপতিসহ ৮জন। এ ঘটনার পেছনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, জড়িত ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে শনাক্ত করতে সন্দেহভাজন যেকোনো ব্যক্তিকে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতাও দেওয়া হয় কমিশনকে। বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমানকে কমিশনের সভাপতি করা হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
গত বছরের জুলাই আগষ্টের গন আন্দোলনের মুখে ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা পুনঃতদন্তের দাবি জোরাল হয়। ওই ঘটনার তদন্তে জাতীয় স্বাধীন কমিশন/কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী।
কমিশনের কার্যপরিধি হিসেবে, পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত ঘটনার প্রকৃতি ও স্বরূপ উদ্ঘাটন করা, হত্যাকা- ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত, সহায়তাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, আলমত ধ্বংসকারী, ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করছে কমিশন। এছাড়া অন্য সব বিষয়সহ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশি-বিদেশি ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ, সংগঠনকেও কমিশন চিহ্নিত করার কাজটিও চলছে। বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যাকা-ের সময় ও হত্যাকা-ের আগে বা পরে হওয়া অন্যান্য অপরাধের স্বরূপ উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ, সংগঠন চিহ্নিত করার কাজ করছে কমিশন। ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়া বা ঘটনায় সহায়তাকারী অন্যান্য দেশি বিদেশি ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও সংগঠনের সম্পৃক্ততা ও দোষীদেরও কমিশন চিহ্নিত, হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য অপরাধ ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও সংগঠনও শনাক্ত করার কাজটি করছে এই তদন্ত কমিশন। প্রজ্ঞাপন অনুসারে , হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য অপরাধে ইতোমধ্যে করা মামলা, ওই মামলায় অভিযুক্তদের দায় ও অপরাধ অক্ষুণন্ন রাখার পাশাপাশি যারা মামলা থেকে বাদ পড়েছে সেই সব আসল অপরাধীদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার কাজটিও কমিশন করছে বলে জানা গেছে। কমিশনকে প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা বলা হয়েছে। সে হিসেবে চলতি জুন মাসের ৩০ তারিখে কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে, কমিশনের মেয়াদ আরও ৩ মাস বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সাড়া মেলেনি শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনের : শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনকে সাক্ষ্য দিতে ডাকলেও জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনরে ডাকে সাড়া মেলেনি কারও। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কমিশন পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কমিশনের ধানমন্ডি কার্যালয়ে হাজির হয়ে বা অনলাইনে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কেউ হাজির হননি, অনলাইনেও স্বাক্ষ্য দেননি।
কমিশনের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত হত্যাকা-ের তদন্ত প্রক্রিয়ায় ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাঁরা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক, জামালপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি মির্জা আজম, ঢাকা-৮ আসনের সাবেক এমপি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের তৎকালীন অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ শামসুল আলম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ ও পুলিশের সাবেক সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম।
এসব ব্যক্তি দুই পদ্ধতির যেকোনো একটি মাধ্যমে সাক্ষ্য দিতে পারেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। একটি হচ্ছে কমিশনের কার্যালয়ে হাজির হয়ে সাক্ষ্য প্রদান। কমিশনের কার্যালয়ে হাজির হয়ে সাক্ষ্য প্রদানে আগ্রহী ব্যক্তিরা +৮৮০১৭১৪০২৬৮০৮ মুঠোফোন নম্বরে সরাসরি যোগাযোগ করে অথবা পড়সসরংংরড়হ@নফৎ-পড়সসরংংরড়হ.ড়ৎম এই ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সাক্ষাতের সময়সূচি নির্ধারণ করে কমিশনের কার্যালয়ে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে পারবেন।
কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অনলাইনেও সাক্ষ্য দেওয়া যাবে। ওই মুঠোফোন নম্বরে অথবা ওই ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সাক্ষাতের সময়সূচি নির্ধারণ করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য দেওয়া যাবে। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন ওই ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম ৩১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করতে চায়। এ কারণে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সাত দিনের মধ্যে সাক্ষীদের তাঁদের প্রস্তাবিত সময়সূচি ফোনকল অথবা ই-মেইল অথবা পত্রের মাধ্যমে কমিশনের ঠিকানায় লিখিতভাবে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। সাক্ষীদের অসহযোগিতার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন আইনানুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে ওই ১৫ জনের কথা শুনতে চায় কমিশন। এ জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে, যাতে কমিশনের বার্তা তাঁদের (সাক্ষ্য দিতে ডাকা ১৫ জন) কাছে পৌঁছায়। আর যে মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে, আশা করি, সাক্ষীরা সেই মাধ্যম ব্যবহার করে সাড়া দেবেন।
এদিকে, বিডিআর হত্যাকা-ের তদন্ত কার্যক্রমে সহায়ক তথ্য দিয়ে কমিশনকে সাহায্য করার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে সাড়া দিয়ে সহ¯্রাধিক ব্যক্তি তথ্য প্রদানসহ স্বাক্ষ্যও দিয়েছেন বলে জানা গেছে। নৃশংস এ হত্যাকা- তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ওয়েবসাইট ছাড়াও নানা মাধ্যমে এ তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তিটি গত ১৮ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়।