অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করা হবে। গতকাল রোববার প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার নির্দেশনা চেয়ে একটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান এটি পাঠিয়েছেন।
এই নির্বাচন জাতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় জনগণের ভোট যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কমসংখ্যক ভোট পেয়েও প্রার্থীরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক ভোট কোনোভাবেই সংসদে প্রতিফলন পাচ্ছে না। এতে জনগণের ভোটের সমান মর্যাদা লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং সংসদে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না।
বর্তমান ব্যবস্থার কারণে নির্বাচনে কালো টাকা, পেশিশক্তি ও দখলদারিত্ব প্রভাব বিস্তার করে। অপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত গোষ্ঠীগুলো স্থানীয়ভাবে ভোট কেন্দ্র দখল বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জয়ী হয়। সংসদে প্রবেশের পর তারা জনগণের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। ফলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, সুশাসন ব্যাহত হয় এবং সাধারণ মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
এই বাস্তবতায় প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল (বিএনপি ও তাদের মিত্র দল ব্যতীত) দাবি তুলেছে যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই পদ্ধতিতে জনগণের প্রতিটি ভোট সমান মূল্য পাবে এবং দলীয়ভাবে যত শতাংশ ভোট পাওয়া যাবে, সংসদে সেই অনুপাতে আসন বণ্টন হবে। এতে ছোট দল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরও সংসদে প্রতিফলিত হবে এবং একচেটিয়া দখলদারিত্ব কমে আসবে।
পিআর পদ্ধতির সুফল
১. প্রতিটি ভোটের সমান মূল্যায়ন হয়।
২. জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টিত হয়।
৩. ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
৪. কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব কমে আসে।
৫. দলগুলোকে নীতিনির্ভর প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়।
৬. সংসদ বহুমাত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
পিআর/চজ পদ্ধতি ইতোমধ্যেই বহু উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে চালু রয়েছে।
জার্মানি: এখানে মিশ্র প্রোপোরশনাল পদ্ধতি চালু আছে। এতে স্থিতিশীল জোট সরকার গঠিত হয় এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকে।
সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড: এই দেশগুলো তালিকাভিত্তিক পিআর ব্যবস্থা চালু রেখেছে এবং তারা ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনের মানদ-ে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে।
নেদারল্যান্ডস: এখানে শতভাগ পিআর পদ্ধতি কার্যকর; যেখানে প্রতিটি ভোট সংসদে প্রতিফলিত হয়।
নিউজিল্যান্ড: তারা ১৯৯০-এর দশকে পিআর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং আজ এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও জনমুখী গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণ আফ্রিকা: এখানে জাতীয় তালিকাভিত্তিক পিআর ব্যবস্থা বর্ণবৈষম্যের অবসানের পর সমতা ও অন্তর্ভুক্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশও যদি এই পদ্ধতি গ্রহণ করে; তবে জনগণের আস্থা ফিরবে, নির্বাচনের সহিংসতা কমবে, কালো টাকার প্রভাব হ্রাস পাবে এবং সংসদে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটবে।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে একটি আইনি নোটিশ প্রদান করেন। উক্ত আইনি নোটিশে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনকে বিবাদী করা হয়েছে। রেজিস্ট্রি ডাকযোগে ও ইমেইল এর মাধ্যমে উক্ত আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে আসন্ন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে পিআর পদ্ধতিতে আয়োজনের জন্য অবিলম্বে সাংবিধানিক সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও বিধান জারি করতে হবে, যাতে দলসমূহ সময়মতো প্রস্তুতি নিতে পারে। এছাড়াও দলীয় তালিকা স্বচ্ছ রাখা, নারী ও সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, নির্বাচনি ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করা এবং কালো টাকার ব্যবহার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, যদি সরকার ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে রিট আবেদন দায়ের করা হবে।