জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামী সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবীর নানকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করতে আইজিপি বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি এ তথ্য জানান।
অন্য আসামীরা হলেনÑসাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে ১০ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে আইজিপিকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাজুল ইসলাম বলেন, আইসিটি এখন পর্যন্ত ৩৩৯টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে এবং অভিযোগ নিবন্ধন অনুযায়ী তদন্তকারী দল ৩৯টি মামলা তদন্ত করছে। এ পর্যন্ত ২২টি বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৪১ জন ব্যক্তি অভিযুক্ত। এর মধ্যে ৪টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রায় প্রস্তুত।
তিনি আরও জানান, ১৪১ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৫৪ জনকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ৮৭ জন এখনো পলাতক। এই ১৪১ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৭০ জন সিভিলিয়ান, ৬২ জন পুলিশ এবং ৯ জন বিভিন্ন সেনাবাহিনীর সদস্য।
টাইম বোমা নিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আমিসহ গুমের মামলার তদন্তে যাওয়া দলের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে টাইম বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে কোনো তথ্য উপাত্ত যেন ফাঁস না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কাজ করছি। সকল ছিদ্র বন্ধ করার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করতে গিয়েছিলাম গুমের বিষয়ে। সেখানে গিয়ে অনেক কিছু আমরা দেখেছি। টাইম বোমা দেখেছি। হয়তো এই টাইম বোমা সেট করা হয়েছিল তদন্তকারী দলকে হত্যার পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে। আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমরা সেখানে গিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলেছি। ছবিগুলো ভুক্তভোগীদের দেখিয়েছি। ভুক্তভোগীরা দেখে বুঝতে পেরেছেন এটাই ছিল আয়নাঘর। এই আয়নাঘরে ভুক্তভোগীদের নিয়ে টর্চার করা হতো। বোমা দেখে আমি আমার সঙ্গে থাকা প্রসিকিউটরকে সাবধান করি। বোমা টাচ না করতে বলি। পরে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা আয়নাঘর পরিদর্শনের ঠিক দুইদিন পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখানে পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সেখানে আর যাননি। আয়নাঘরের অন্য জায়গায় পরিদর্শন করেছেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেড় হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। ২৫ হাজারের মতো ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। সব ঘটনার জলজ্যান্ত প্রমাণ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আমরা সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হব। আশুলিয়ায় লাশ পুড়িয়ে ফেলা, চানখারপুল গণহত্যা, রামপুরায় একটি আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে ঝুলন্ত যুবককে গুলি করা এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলাÑএই চারটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রায় প্রস্তুত, এবং সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যাদের মূল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছি, যারা এই নৃশংসতার পেছনে ছিলেন, তাদের বিচার চাই। আমরা পূর্ববর্তী ট্রাইব্যুনালের প্রমাণের মান অনুসরণ করতে চাই না। আমরা উজ্জ্বল সত্যটি উপস্থাপন করেছি, তাই তদন্তের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে না।
তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত ১,০০০ জনের বেশি সাক্ষীর বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে এবং ১,০০০টিরও বেশি ভিডিও ক্লিপসহ ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, সংগ্রহকৃত ডিজিটাল প্রমাণ পর্যালোচনা করছি, সেগুলোর যাচাই-বাছাই করছি এবং জিও-লোকেশন যাচাই করছি। তদন্তের জন্য আমরা ১৫টি জেলা পরিদর্শন করেছি, যার মধ্যে নরসিংদি, হবিগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, এবং রংপুর অন্তর্ভুক্ত।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার জোরপূর্বক গুমের সাথে সম্পর্কিত তিনটি স্থান এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় তিনটি স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে এবং সেখানে প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি কেবল ঐতিহ্যগত প্রসিকিউশন কাজ নয়, আমরা উত্তর দক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি) এবং তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা (যাত্রাবাড়ী) সহ চারটি পাবলিক শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছি, যাতে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়।
মতবিনিময় সভার শুরুতে, প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার এবং গাজী এমএইচ তামিম আইসিটির কার্যক্রম এবং মামলার তদন্ত আপডেট নিয়ে দুটি ডিজিটাল উপস্থাপনা প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া, প্রসিকিউটর আবদুস সুবহান তারফদার, মিজানুল ইসলাম এবং আবদুল্লাহ আল নোমানও উপস্থিত ছিলেন।