গাজীপুরে নতুন গঠিত গাজীপুর-৬ আসন বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি ও রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এটর্নি জেনারেল দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়েছে। বুধবার (১২ নভেম্বর) সকালে চেম্বার জজ আদালতে আপিল দায়েরের কথা জানিয়েছেন সূত্রগুলো।
একই সঙ্গে নবগঠিত গাজীপুর-৬ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও পৃথকভাবে পক্ষভুক্ত হতে আবেদন প্রস্তুত করেছেন। জামায়াত নেতা ড. হাফিজুর রহমান, বিএনপি নেতা রাকিব উদ্দিন সরকার পাপ্পু, সালাহউদ্দিন সরকার, প্রভাষক বসির উদ্দিন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আরিফ হোসেন হাওলাদারও আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী ড. হাফিজুর রহমান বলেন, গাজীপুর-৬ আসন ছিল গাজীপুরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতিফলন। আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করছি। নির্বাচন কমিশন এবং জনগণ উভয়ের স্বার্থেই গাজীপুর-৬ আসন পুনর্বহাল হওয়া সময়ের দাবি।
গাজীপুর মহানগর জামায়াতের আমীর অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, গাজীপুর একটি শিল্পনগরী ও জনবহুল মহানগর। ছয়টি সংসদীয় আসন এখানকার জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই আমরা আশা করছি, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক এমপি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, গাজীপুরবাসীর ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করা যাবে না। আমরা শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে গাজীপুর-৬ আসন পুনর্বহাল করব।
এদিকে, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর সাবেক সভাপতি এম আব্দুল্লাহ বিষয়টি নিয়ে সংবিধানগত বিশ্লেষণ তুলে ধরে বলেন, সংসদীয় সীমানা নির্ধারণ সংবিধানের ১১৯(গ), ১২৪ ও ১২৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। আদালতের এখতিয়ার এখানকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা নয়, তবে রায়ের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে একটি নতুন ব্যাখ্যার সূত্রপাত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাগেরহাট জেলায় একটি আসন কমানো এবং গাজীপুরে একটি আসন বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছিল, সেটি বাতিল করে আদালত নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তবে সংবিধানের ১২৫(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে—এই বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। ফলে এটি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ আইনি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এম আব্দুল্লাহ ব্যাখ্যা করেন, সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও আসন বণ্টন কেবল নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। এই ব্যাখ্যার আলোকে ভবিষ্যতে আদালত ও কমিশনের ক্ষমতার সীমা নিয়ে আরও স্পষ্টতা আসবে বলে আশা করা যায়।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালেও যখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও গাজীপুরে নতুন আসন বৃদ্ধি করা হয়, তখনও আদালত রিট শুনেনি। কিন্তু এবার শুনানি ও রায় দুটোই হয়েছে, ফলে সংবিধান ও বিচারব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে নতুন আলোচনার দরজা খুলে গেছে।
এদিকে প্রভাষক বসির উদ্দিন জানান, আমরা সম্মিলিতভাবে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দিয়েছি। বুধবার আপিল হলে বৃহস্পতিবারই শুনানি হতে পারে। পাশাপাশি বুধবার সকাল ৯টা থেকে টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেন তিনি।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, গাজীপুর-৬ আসনের পক্ষে আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ। ইনশাআল্লাহ, এই ঐক্যের শক্তিতেই আসবে বিজয়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মাজহারুল আলম বলেন, গাজীপুরে পাঁচটি আসন থাকলে এটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় আসন বৈষম্য। বাসন মেট্রোথানা ঐতিহাসিক ও প্রশাসনিকভাবে গাজীপুর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। আমরা আশা করি, আপিলে সংবিধানসম্মত সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে।
টঙ্গী প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ্ব মেরাজ উদ্দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, গাজীপুর-৬ আসন টঙ্গীবাসীর মর্যাদার প্রতীক। রাজনৈতিক দল ব্যর্থ হলে টঙ্গী প্রেসক্লাব ও নাগরিক সমাজ পৃথকভাবে রিট করবে। টঙ্গী সচেতন নাগরিক পরিষদও এতে পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আপিল দায়েরের পর গাজীপুরে নতুন রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে টঙ্গী, গাছা ও হায়দারাবাদ অঞ্চলে বিএনপি, জামায়াত ও নাগরিক সংগঠনগুলো মাঠে নেমে পড়েছে। রাজনৈতিকভাবে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—গাজীপুর-৬ কি ফিরবে? নাকি ইতিহাসেই রয়ে যাবে -হারানো একটি আসনের গল্প?